২ যুগ পেরোনো চারুকলার চিকেন ফ্রাই

চিকেন ফ্রাই, আলু চপ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। নিচে সঞ্জিত ঘোষ ও মো. সাদেক। ছবি:মাহমুদ নেওয়াজ জয়

শাহবাগ মোড় থেকে সোজা এগিয়ে এলে টিএসসি যাওয়ার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ৩ নম্বর গেটের সামনে চোখে পড়ে একটি দোকান। সেখানে গরম তেলে ভাজা হচ্ছে চিকেন ফ্রাই। এ ছাড়া রয়েছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও আলুর চপ।

দোকানের সামনে ক্রেতাদের ভিড়। কয়েক মিনিটের ভেতরই শেষ হয়ে যাচ্ছে চিকেন ফ্রাই। আবার বড় কড়াইয়ে বেসনে মাখানো চিকেন ছেড়ে দিয়ে ভাজাভুজি করে চলেছেন নীল শার্ট পরা মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি।

'মামা, ৬টা চিকেন', 'মামা, আমরা ৩ জন, চিকেন ১২টা', 'মামা, ২টা চপ, ১টা চিকেন আর ১০ টাকার ফ্রাই' - এমনভাবে ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী দিয়ে চলেছেন একের পর এক ফরমায়েশ। আর সেইসঙ্গে ভাজা হয়ে গেলেই একবারে ৩০-৪০ পিস চিকেন ফ্রাই উঠে আসছে কড়াই থেকে ট্রেতে।

কথা বলে জানা গেল, ভাজাভুজি করতে থাকা সেই ভদ্রলোকের নাম সঞ্জিত ঘোষ। তার সঙ্গে আছেন আরও ২ জন বিক্রেতা, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন মো. সাদেক। সহায়তা করছেন মুহিত নামে এক তরুণ।

প্রতিদিনই বিকেল ৪টার পর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ৩ নম্বর গেটের সামনে এভাবে চিকেন ফ্রাই, আলুর চপ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিক্রি হয়। 'চারুকলার চিকেন' নামে পরিচিত এই চিকেন ফ্রাইয়ের স্বাদ নেওয়ার জন্য ভিড় লেগেই থাকে দোকানের সামনে।

সঞ্জিত ঘোষ জানান, তারা এই দোকান শুরু করেছেন ২৫-২৬ বছর আগে। সে সময় অবশ্য বিখ্যাত এই চিকেন ফ্রাই ছিল না। শুরুটা হয়েছিল পেঁয়াজু, বেগুনি, সমুচা, শিঙাড়া, জিলাপি ইত্যাদি দিয়ে।

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

একের পর এক ক্রেতাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী খাবার দিতে দিতে কথা বলতে থাকলেন মো. সাদেক। তিনি জানান, দোকান প্রথমে এখানে ছিল না। আরেকটু সামনে ছিল।

ইঙ্গিতে দেখালেন সামনের একটি জায়গা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি যেখানে, তার কিছুটা আগে ছিল তাদের দোকান। সেটা ৯০ দশকের শেষ দিকের কথা।

সঞ্জিত ঘোষ জানান, চিকেন এসেছে আরও পরে। সেটা ঠিক কখন? উত্তর পাওয়া গেল মো. সাদেকের কাছ থেকে।

তিনি বললেন, '২০০৪-৫ সালের দিক থেকে আমরা চিকেন ফ্রাই বানাতে শুরু করি। আগে পেঁয়াজু, বেগুনি, শিঙাড়া, সমুচা এগুলোই চলতো। পরে ফার্মগেটে এক দোকানের চিকেন ফ্রাই খেয়ে আমার ভালো লেগে যায়। কীভাবে বানায় সেটা দেখি। তারপর সেখানকার এক কারিগরকে নিয়ে আসি আমাদের এই দোকানে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা ৩ নম্বর গেটের এখানে দোকান করেছি আরও পরে। একদম শুরুতে আরেকটু সামনে দোকান ছিল, তারপর ছিল এই গেটের পরের গেটটায়। তারপর থেকে এখানে।'

মো. সাদেকের ভালো লেগে যাওয়া ফার্মগেটের সেই চিকেন ফ্রাইয়ের মতো করেই এখানে বানাতে শুরু করেন তারা। মুরগির মাংস ছোট করে কেটে বেসন দিয়ে মাখিয়ে রেখে ডুবো তেলে ভেজে ফেললেই তৈরি হয়ে যায় এই চিকেন ফ্রাই। কথা বলতে বলতেই দেখা গেল, ৩০ পিসের মতো চিকেন ফ্রাই কড়াই থেকে তুলে ট্রেতে রাখলেন সঞ্জিত ঘোষ।

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

মুহূর্তেই আশপাশ থেকে আসতে লাগল অর্ডার। ক্রেতাদের একজনকে দেখিয়ে মো.সাদেক বললেন, 'কথা বলেন উনার সঙ্গে, উনি আমাদের ২০ বছরের পুরোনো কাস্টমার।'

যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি এসেছিলেন বেশ কয়েক টুকরো চিকেন ফ্রাই পার্সেল নিতে। পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, তার নাম আবুল কালাম আজাদ। বর্তমানে পুলিশে কর্মরত আছেন। স্মৃতি রোমন্থন করে ফিরে গেলেন অতীতে।

বললেন, 'আমি ২০০১-০২ সেশনের ছাত্র। ইংরেজি বিভাগে ছিলাম। এখন এএসপি হিসেবে কর্মরত। এখানে ২০০৫ সালের দিক থেকে এই চিকেন ফ্রাই খেয়ে আসছি। তখন প্রতি পিসের দাম ছিল ৫ টাকা। ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ২০০৯ সালে। তবে এই চিকেন ফ্রাইয়ের প্রতি মুগ্ধতা এখনো আছে। তাই মাঝেমাঝেই আসি।'

সঞ্জিত ঘোষ জানালেন, ৫ টাকা দিয়ে শুরু হলেও এই চিকেন ফ্রাইয়ের দাম এরপর ৭ টাকা, ৮ টাকা, ১০ টাকা ছিল নানা সময়। মাঝে একবার ১৫ টাকা করলেও পরে দাম স্থির হয় ১২ টাকা।

মো.সাদেক যোগ করলেন, 'করোনার পরের কথা। তখন মুরগির দাম বেড়ে হয়েছিল ২৫০ টাকা/ ২৬০ টাকা কেজি। তাই চিকেন ফ্রাই ১৫ টাকা করা হয়েছিল। পরে সেটা কমিয়ে ১২ টাকায় আনা হয়েছে।'

সঞ্জিত ও সাদেক থাকেন কারওয়ান বাজারের দিকে। সঞ্জিত জানান, কারওয়ান বাজারের পরিচিত এক দোকান থেকেই নিয়মিত মুরগি কেনেন।

সাদেক বললেন, 'এখন ১৮০ টাকা কেজি কিনি। তবে ঠিক কেজি হিসেবে ফিক্সড করে মুরগি কেনা হয় না। আমরা দিনে ১০-১২টা মুরগি কিনি। সেখান থেকে যে পরিমাণ মাংস হয় আর কী।'

সঞ্জিত বললেন, ' দিনে ১৫ কেজি- ২০ কেজি পরিমাণ মাংস বিক্রি হয়। সে হিসাবে চিকেন ফ্রাই ৫০০ পিসের মতো বিক্রি তো হয়ই। কিছু কম-বেশি থাকতে পারে। শুক্রবারে যেমন অন্যান্য দিনের চেয়ে বিক্রি বেশি হয়।'

ক্যাম্পাস এলাকায় অনেক সময় দোকান বসানো নিয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় দোকানিদের।

এ বিষয়ে মো. সাদেক বললেন, 'আসলে জায়গা তো আমাদের না। জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের। অতীতে এমন হয়েছে কয়েকবার। দোকান বসানো নিয়ে নিষেধ করা হয়েছে। তখন হয়তো কিছুদিনের জন্য আমরা বন্ধ রাখি। তবে খুব বড় কোনো সমস্যা হয়নি। দোকান বসানোর জন্য কাউকে কোনো চাঁদা বা অর্থ দেওয়ার মতো ব্যাপার ঘটেনি।'

কথা বলতে বলতে ব্যস্ত হাতে ভাজার কাজ করছিলেন সঞ্জিত। প্লেটে করে পরিবেশন করছিলেন সাদেক। চিকেন ফ্রাইয়ের পর একদম গরম আলুর চপ ভেজে তুললেন সঞ্জিত। চিকেন ফ্রাইয়ের মতো অত বেশি নয়, তবে এই চপ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়েরও দেখা গেল ভালোই চাহিদা আছে।

সঞ্জিত বলছিলেন, 'যখন ৫ টাকা করে ফ্রাই বিক্রি করেছি, সেই সময়ের তুলনায় এখন মুরগির দাম তো বেড়েছে। তবে লাভের জায়গা থেকে আমরা সেই হারে চিকেন ফ্রাই, আলুর চপের দাম বাড়াইনি। এখানে ভার্সিটির ছেলে-মেয়েরাই খেতে আসে বেশি, প্রতিদিন বিক্রিও ভালোই হয়। বিকালের পর, বলতে পারেন অফিস টাইমের পর থেকে আমরা বেচা-বিক্রি শুরু করি। রাত ৯টা পর্যন্ত চলতে থাকে গরম গরম ভাজা আর বিক্রি-বাট্টা।'

 

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

1h ago