দিনে ৩২ হাজার টাকার বিক্রি, কী বিশেষত্ব ফরিদপুরের মামুনের চটপটির
সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা। ফরিদপুর শহরের নিলটুলী মহল্লার মুজিব সড়কে বাটা বাজারের পাশে একটি রিকশা ভ্যানকে ঘিরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের জটলা দেখা যায় প্রতিদিন।
কাছাকাছি গেলে দেখা যায়, একটি চটপটি দোকানকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এই জটলা। মানুষের ভিড় সামলে সবাইকে চটপটি তুলে দিতে গলদঘর্ম হবার দশা এক ব্যক্তির। তাকে সাহায্য করছেন আরও ৫ জন। কারো যেন দম ফেলারও সময় নেই কাজের চাপে। ভিড় যখন বেশি হয়, তখন আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় এক বাটি চটপটির জন্য।
যার চটপটির দোকানকে ঘিরে এত ভিড়, তার নাম মামুন হোসেন (৪০)। একটি রিকশা ভ্যানকে দোকানের আদলে সাজিয়েছেন তিনি। দোকানের নাম 'শাহী চটপটি ও হালিম'।
মামুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ২০১৫ সাল থেকে এখানে চটপটি ও হালিম বিক্রি করে আসছেন। প্রথমে হালিম দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু খাসির মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ততটা সুবিধা করতে পারেন নি। এরপর চটপটি বিক্রিতেই মনোনিবেশ করেন। মামুনের ভাষ্যমতে, এই চটপটি একবার যিনি মুখে দিয়েছেন, বারবার তার না খেয়ে আর উপায় থাকে না। তার তৈরি চটপটি প্রতি বাটি বিক্রি হয় ৮০ টাকা করে, পার্সেল নিলে ১০০ টাকা।
যেভাবে শুরু
মামুনের পৈত্রিক নিবাস বোয়ালমারী উপজেলার দাঁতপুর ইউনিয়নের কোন্দার দিয়া গ্রমে। বাদশা মোল্লা ও পেয়ারী বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। বড় সন্তান হওয়ায় ছোটবেলাতেই মামুনের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল সংসারের হাল ধারার। জীবন ও জীবিকার জন্য তিনি ভাঙারির ব্যবসা শুরু করেন। বাবা-মা পরিবার পরিজন নিয়ে চলে যান রাজশাহীতে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর গত ১৫ বছর আগে তিনি ফিরে আসেন ফরিদপুরে। সেখানেও ভাঙারির ব্যবসা শুরু করেন। বারোভাজাও বিক্রি করতেন অবসর সময়, বিশেষত রাতের বেলায়।
ফরিদপুরে এসে এক সময় মামুনের মনে হয়, ভাঙারির ব্যবসা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব না। সেই চিন্তা থেকে থেকে প্রথমে হালিম ও পরে চটপটির ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
মামুন জানান, তিনি যখন হালিম বানানো শুরু করেন তখন ফরিদপুরে হালিম তৈরির করা হয় এমন বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। তিনি ঘুরে ঘুরে প্রতিটি দোকানের হালিম খেয়ে দেখেছেন। অন্য সব দোকানের মান দেখে নিজের চিন্তা থেকে তিনি হালিম বানানোর কাজ শুরু করেন। তার প্রত্যাশা ছিল, মানুষকে ভালো, টাটকা খাবার দেবেন। রাতারাতি মামুনের হালিম জনপ্রিয় হয়ে উঠে মান ও স্বাদের গুণে। মাংসের পরিমাণও ছিল অনেক বেশি।
করোনার সময় তার দোকানটি ১ বছরের মত বন্ধ ছিল। এরপর তিনি চটপটি বানানো শুরু করেন। এখানেও তিনি একই পদ্ধতি অনুসরণ করেন ভালো মানসম্মত ও টাটকা খাবার পরিবেশেন করার। ফলে ফরিদপুর শহরে চটপটি মানেই যেন মামুনের চটপটি হয়ে উঠে।
স্বাদের রহস্য
কেন তার চটপটির প্রতি মানুষের এত আগ্রহ, এই চটপটির বিশেষত্ব কী- জানতে চাইলে মামুন জানান, প্রতিদিন তিনি নিজে ২ দফা বাজার করেন। প্রতিটি সামগ্রী টাটকা ও যাচাই করে কেনেন। ফজরের নামাজ পড়েই প্রথম দফা বাজারে গিয়ে টাটকা শশা, কাঁচামরিচসহ কাঁচা উপাদানগুলো কিনে আনেন। এরপর সকাল ৯টার দিকে দ্বিতীয় দফা বাজারে যান। তখন চটপটির মশলাসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনে আনেন।
মশলাসহ চটপটির অন্যান্য সামগ্রীর দাম ফরিদপুরে বেশি হলে আগে তিনি তা ঢাকা থেকেও কিনে আনতেন। অবশ্য এখন আর ঢাকায় যেতে হয় না। সব ফরিদপুরেই পান। পাশাপাশি চটপটির জন্য ভাজা যে জিনিসগুলো তৈরি করতে হয়, তা তিনি বাড়িতেই তৈরি করেন। প্রতিদিনের তৈরি করা সামগ্রী প্রতিদিন ব্যবহার করেন। বাসি কিছু ব্যবহার করেন না। বাড়ির কাজে তাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সাহায্য করেন স্ত্রী রিতা বেগম।
মামুন আরও জানান, প্রতিদিন তিনি ৩০ হাজার থেকে ৩২ হাজার টাকার চটপটি বিক্রি করেন। কর্মচারীদের বেতন ও দ্রব্যসামগ্রী কেনার খরচ বাদ দিয়ে গড়ে তার আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। অবশ্য অনেক বৃষ্টি যে দিন নামে সেদিন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
এখন মামুন এখন শুধু একজন চটপটি বিক্রেতাই নন, পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তাও। চটপটি বিক্রি করে তিনি সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। তার সহযোগী হিসেবে চটপটি বানাতে ও বিক্রি করতে কাজ করেন আরও ৫ জন। তাদের সংসারও চলছে এ চটপটি বিক্রির টাকায়।
গত ৭ বছর ধরে মামুনের চটপটির দোকানে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন ফরিদপুর শহরের কমলাপুর এলাকার বাসিন্ধা তাজেল খান। তিনি জানান, প্রতিদিন তিনি ১ হাজার টাকা করে বেতন পান। মামুনের সঙ্গে কাজ করে পরিবার নিয়ে খুব ভালো আছেন।
এই চটপটি দোকানের আরেক সহযোগী কমলাপুর এলাকার বিলু বিশ্বাস বলেন, 'আমি সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দিনমজুরের কাজ করি। আর বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করি মামুন ভাইয়ের দোকানে। তিনি প্রতিদিন আমাকে ৪০০ টাকা করে বেতন দেন। এই কাজে কষ্ট কম, আনন্দ বেশি। কত মানুষ আসে! দোকানের চটপটি খেয়ে আনন্দ পায়। আমার খুব ভালো লাগে।'
সবসময় হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, সদালাপী মামুনের ব্যবহার ও আচরণে সন্তুষ্ট ক্রেতারা। যারা আগে আসেন তাদের খাবার আগে পরিবেশন করা হয়, যারা পরে আসেন তারা পরে পান। এ নিয়ে ক্রেতাদের মনে নেই ক্ষোভ। অনেক অপেক্ষার পরও তারা মামুনের চটপটি খেয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরে যান।
মামুন বলেন, 'ক্রেতারা এসে অনেক সময় দাঁড়িয়ে ভিড় করে চটপটি খান। খেয়ে প্রশংসা করেন। তখন আমার বুকটা আনন্দে ভরে যায়। তবে কষ্ট হয় তখনই, যখন ক্রেতারা চটপটি খেতে এসে দেখেন, খাবার শেষ হয়ে গেছে। তখন এত কষ্ট লাগে বোঝাতে পারব না।'
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের মানিক কুন্ডু বলেন, 'অন্য দোকান থেকে এ দোকানের চটপটির স্বাদ ভিন্ন। তার মতো করে ফরিদপুর শহরে আর কেউ চটপটি বানায় না। এজন্য আমরা প্রায়ই দলবেঁধে এ চটপটি খেতে আসি।'
শহরে এলে মামুনের চটপটি খান ফরিদপুরের সালথার আটঘর ইউনিয়নের খোয়াড় গ্রামের বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা মাফিকুল ইসলামও।
তিনি বলেন, 'ফরিদপুরে নানা কাজে আসতে হয়। এসে মামুনের ১ বাটি চটপটি খেয়ে না গেলে মনে হয় ফরিদপুর আসাটা পরিপূর্ণ হয়নি।'
মামুনের ইচ্ছে জমি কিনে শহরে একটি বাড়ি করার। পাশাপাশি একটি স্থায়ী দোকান নিয়ে চটপটি, হালিমসহ আরও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী তিনি বানাতে চান। তখন আরও অনেককে তিনি কাজে নিয়োজিত করতে পারবেন। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
Comments