কবজি ডুবিয়ে সবজি খেতে জগন্নাথ ভোজনালয়

জগন্নাথ ভোজনালয়। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

পুরান ঢাকার খাবারের কথা বললে সাধারণভাবে আমাদের মাথায় বিরিয়ানির কথাই আসে। তবে মসলাদার মোগল খাবারের বাইরে গিয়ে কেউ যদি একেবারেই নিরামিষ খেতে চান, সেক্ষেত্রে দারুণ একটি স্থান হতে পারে জগন্নাথ ভোজনালয়।

এর অবস্থান ১১০ নম্বর তাঁতিবাজারে একটি ভবনের দোতালায়। নিচতলায় আছে পুষ্প নামে একটি জুয়েলারি দোকান। তাঁতিবাজার শিবমন্দিরের কাছ থেকে সহজেই যাওয়া যায়।

স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করলেও জেনে নিতে পারবেন এর ঠিকানা। ভোজনালয়ের বয়স এখন ১৮ চলছে। দেড় যুগ আগে ২০০৫ সালে নিতাই পাল শুরু করেন এই ভোজনালয়। ওদিকের সবচেয়ে পুরনো নিরামিষ ভোজনালয়টি বিষ্ণুপ্রিয়া। তারপরই হয়েছে জগন্নাথ। ২০২০ সালে কোভিড আক্রান্ত হয়ে লোকান্তরিত হন নিতাই পাল। তারপর মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এর তত্ত্বাবধানে আছেন অশোক কবিরাজ। তিনি গোপীনাথ ভোজনালয়েরও মালিক। এখন দুটো হোটেলই একসঙ্গে চালাচ্ছেন।

তিনি জানান, জগন্নাথ ভোজনালয়ের সব আইটেম নিরামিষ। ভর্তা, ডাল, ছানা, বড়া, সয়াবিন, রসা, ধোকা। শেষপাতে পায়েস আর চাটনি। রান্নায় পেঁয়াজ ও রসুন ব্যবহার করা হয় না। তবে অন্যান্য মসলা দেওয়া হয়। একাদশীর সময় হলে, চন্দ্র তিথিতে বিশেষ খাবার পাওয়া যায়। পুষ্পান্ন (অর্থাৎ পোলাও), খিচুড়ি, সাগুদানা ভুনা, ছানার রসা, ফুলকপির রসা, পাঁচমিশালি সবজি ও শ্যামা দানার পায়েস করা হয়। একাদশীর রান্না হয় সানফ্লাওয়ার তেলে। অন্যান্য দিন সয়াবিন ব্যবহার করা হয়।

ভোজনালয়ের অন্দরে। ছবি: জগন্নাথ ভোজনালয়ের সৌজন্যে

এ ছাড়া, পেঁয়াজ- রসুন তো বাদই, অন্যান্য মসলাও একাদশীর রান্নায় দেওয়া হয় না। শুধু আদা আর কাঁচামরিচটা দেওয়া হয়। এখানে ভর্তা পাওয়া যায় ৮-১০ রকমের। ডাল পাওয়া যায় ৩-৪ প্রকারের। শাকও পাবেন ৫ প্রকারের। হোটেলের টেবিলগুলোয় সারিবদ্ধ করে সাজানো রেকাবি (ট্রে)। সেখানে ইস্পাতের (স্টিল) ছোট ছোট বাটিতে করে সাজানো প্রায় ২০ প্রকারের নিরামিষ পদ। যার যেরকম প্রয়োজন, সেভাবে নিয়ে নিতে পারেন। সব তরকারির দাম ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টাকার ভেতর।

ভাত এক প্লেট ১৫ টাকা, প্রয়োজনে ৫ টাকা করে অতিরিক্ত ভাত নিতে পারবেন। ভাত টেবিলে দেওয়া থাকে না। এটি দোকানের লোকেরাই পরিবেশন করে থাকেন। দৈনিক ২০টি পদ করা হয় এখানে। তার ভেতর রসা, লাবড়া, শুক্তো, ৫ তরকারি, ধোকা-সবই পাবেন। একবারে দোকানে বসে খেতে পারেন ৩৫-৩৬ জন।

তবে ভর দুপুরবেলায় ভিড় আরেকটু বেশিই থাকে। দুপুর ১ টা থেকে সাড়ে ৩ টা -৪টা পর্যন্ত বেশ লোকসমাগম হয় বলে জানান অশোক কবিরাজ। রাতে ১০টা পর্যন্ত সাধারণত দোকান খোলা রাখেন। তবে ভিড় বাড়লে সেটি বেড়ে হয় ১১টা।

অশোক কবিরাজ বলেন, 'আমরা এখানে প্রতিদিন কেমন লোক খাবে, সেসব হিসাব করেই রান্না চড়াই। দরকারে কম হবে। কিন্তু বেশি খাবার যেন না হয় বা বেঁচে না যায়, তা খেয়াল করি আমরা। তাছাড়া, নিরামিষ খাবার বাসি হলে দেখে বোঝা যায়। কালচে হয়ে যায়। সেটা খাওয়ার উপযোগী থাকে না।'

মূলত নিরামিষ আহারি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কথা চিন্তা করে হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও সব ধর্মের মানুষের জন্যই এটি উন্মুক্ত। এখানে দূর-দুরান্ত থেকেও অনেকেই খেতে আসেন।

রকমারি পদের সমাহার রয়েছে এখানে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈকত কবির শায়ক জানালেন তার এখানে নিরানিষ ভোজনের অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, 'খাবার আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। যে পরিমাণ ও যেমন মান, তাতে বলা যায় বেশ সাশ্রয়ী। এলাকাটা একটু ঘিঞ্জি, তবে দোকানের পরিবেশ ছিমছাম।'

স্থানীয় আরেকজন তরুণ জানালেন, তিনি প্রায়ই এখানে আসেন খেতে।

তার অভিমত, 'এখানে আপনি পেট ভরে খেতে পারবেন অল্প টাকায়। অন্তত ৬০ টাকা খরচ করলেই ৩-৪টি আইটেম দিয়ে আরামে খেতে পারবেন। রান্না তৃপ্তিদায়ক। এজন্য মাঝে মাঝেই আসি।'

অশোক কবিরাজ জানান, পূজার সময় এখানে খুবই ভিড় হয়। বন্ধের দিনেও লোক বেশি হয়। শুক্রবার ছুটি থাকায় অনেকে আসে। অন্যান্য দিনেও শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, ইসলামপুর, নবাবপুর থেকে মানুষ আসে। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তো আসেই।

আজকাল ভ্লগাররাও আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'দূর-দূরান্ত থেকে কেউ যদি আসতে না পারেন, সেক্ষেত্রে আছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। ফুডপান্ডা, পান্ডা গোর মতো অ্যাপগুলো থেকে অর্ডার করে পেতে পারেন খাবার।'

করোনায় আগের মালিক নিতাই পালের মৃত্যুর পর নতুন করে দায়িত্ব নেওয়াটা একেবারে সহজ ছিল না অশোক কবিরাজের জন্য। তখন হোটেল বন্ধও রাখতে হয়েছিল অনেক দিন। এখন দোকানের সার্বিক অবস্থা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। দোকানে এখন কর্মচারী আছেন ২০ জনের মতো। রান্না, কাটা-বাছা, পরিবেশনা সবকিছুই তারা করেন।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আইটেমের বৈচিত্র‍্য ও মানের কারণে জনপ্রিয় ছিল দোকানটি। এখনও সেই মান অটুট আছে বলে জানান অশোক। তা ছাড়া মসলা, তেল-চর্বিবিহীন নিরামিষ খাবারগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।

তিনি বলেন, 'এখানে আপনি যেটাই খান, তৃপ্তি পাবেন। আইটেমগুলো থেকে টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো সব স্বাদের খাবার পাবেন। যেটা যেরকম পছন্দ, যতটুকু পছন্দ নেবেন। টেবিলে সব দেওয়াই থাকে, পছন্দমতো তুলে নেবেন। ঢাকার অনেক জায়গায় সুস্বাদু পোলাও- বিরিয়ানি পাওয়া যায়। কিন্তু যদি বাড়ির রান্নার মতো শান্তি করে একটু ভাত-তরকারি চান বা বাঙালি রান্না খেতে চান, তবে এখানে চলে আসবেন। খেয়ে তৃপ্তি পাবেন এই নিশ্চয়তা দিতে পারি।'

 

Comments

The Daily Star  | English

One killed in multi-vehicle crash on Dhaka-Mawa highway

The chain of crashes began when a lorry struck a private car from behind on the Mawa-bound lane

54m ago