কমেছে ব্যাংক ঋণ, সংকটে ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে চলছে?

পরিস্থিতি বুঝতে এমন প্রশ্ন রাখা যায় ওয়ার্কশপ, গ্রামীণ হস্তশিল্প, মুদি দোকান ও জুতা তৈরির ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে।

এই উদ্যোক্তারা গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন। সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তারা।

পণ্যের বেশি দামের কারণে ক্রেতাদের চাহিদা কমে গেছে। বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটি বিল বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে পরিচালন খরচও।

ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ নেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।

প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এক-চতুর্থাংশ অবদান রাখছে। মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এসব শিল্পে জড়িত। ২০২৪ সালের শেষের দিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি দেশব্যাপী বিক্ষোভ, সহিংসতা, কারফিউ, বন্যা ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার সিএমএসএমইগুলোকে কাবু করে ফেলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের তথ্যেও সিএমএসএমইর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চিত্র উঠে এসেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জুনে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পরবর্তী প্রান্তিকে তা কমে হয় ৪২ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরের এর একই সময়ের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল-জুনে ঋণ বিতরণ ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সিএমএসএমই খাতে দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। আগের অর্থবছরের দুই লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার তুলনায় শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি।

ঋণের চাহিদা কম থাকায়, নতুন বিনিয়োগের অভাব এবং সরকারি টি-বিল ও বন্ডে সুদ বাড়ানোর কারণে গত বছরের নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ব্র্যাক ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ব্যাংকিংয়ের প্রধান সৈয়দ আবদুল মোমেনের মতে, ব্যবসায়ীরা মূলত দুই কারণে ঋণ চান: পরিচালন খরচ মেটানো ও ব্যবসা সম্প্রসারণ।

'বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসা বাড়াতে ঋণের চাহিদা নেই বললেই চলে,' জানিয়ে তিনি বলেন, 'উদ্যোক্তারা এখন পরিচালন খরচ মেটাতে আর্থিক সহায়তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।'

একই মত প্রকাশ করে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এসএমই ও কৃষি ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান সঞ্জীব কুমার দে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেশি সুদে ঋণ গত তিন বছরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্যবসায়ীরা মূলত প্রবৃদ্ধির তুলনায় টিকে থাকার দিকে মনোযোগ দেন। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে।'

'ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে'

ইস্টার্ন ব্যাংকের হেড অব অ্যাসেট মোহাম্মদ সালেকিন ইব্রাহিম মনে করেন—গত বছরের জুলাই বা আগস্টের তুলনায় বর্তমানে ব্যবসার পরিবেশ ও ঋণ পরিস্থিতির উন্নত হয়েছে।

তার ভাষ্য, গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল। সে সময় কারফিউয়ের পাশাপাশি সাধারণ ছুটিও ছিল।

'ব্যাংকগুলো যেমন গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না, তেমনি গ্রাহকরাও ব্যাংকের সেবা পাচ্ছেন না। আগস্ট থেকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি।'

ব্যাংকগুলো সম্ভাব্য গ্রাহকের খোঁজ করছে জানিয়েছে তিনি আরও বলেন, 'তবে বর্তমান ব্যবসার পরিবেশ ও উচ্চ সুদহার বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।' গ্রাহকের আস্থা ফিরে না হওয়া পর্যন্ত ঋণ বিতরণের হার কম থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের মে মাস থেকে নীতিহার ক্রমাগত বাড়াচ্ছে।

বিশেষ করে, গত বছরের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার পর ঋণের সুদহার ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।

গত বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে।

'ব্যবসায়ীদের সরকারি সহায়তা প্রয়োজন'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমানের মতে, ক্রেতাদের আস্থা (কনজুমার কনফিডেন্স) সর্বনিম্ন পর্যায়ে। গত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে এটি নজিরবিহীন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসায়ীরাও ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে লড়াই করছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়।'

অনিশ্চিত ও আস্থাহীন পরিবেশে ব্যবসায়ীরা ঋণের দায় নিতে দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে করেন তিনি।

২০২৪ সালের জুন থেকে ব্যবসার পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল নয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে ঋণ বিতরণ আগের বছরের তুলনায় অনেক কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

'সরকারের সময়মতো আর্থিক সহায়তা ছাড়া ঋণ বিতরণ ফিরিয়ে আনা ও এই সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা প্রায় অসম্ভব,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মেলিতা মেহজাবিন ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২১ ও ২০২২ সালে এসএমই খাতে উল্লেখযোগ্য ঋণ বিতরণ মূলত পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ও করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কারণে হয়েছিল।'

তবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ কমেছে, জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'চলতি মূলধনের ৩০ শতাংশের ঋণসীমা অতিক্রম করলে ঋণগ্রহীতাদের নতুন ঋণের জন্য আবেদন করার সামর্থ্য আরও কমিয়ে দেয়।'

এ ছাড়াও, ঋণের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ এবং ছোট ঋণগ্রহীতাদের প্রতি ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ায় অনাগ্রহ ঋণ বিতরণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম থাকলেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এসএমই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে।'

তার মতে, 'গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিক্রি ও মুনাফা অনেক কমেছে।'

এসব সংকট যথাযথভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তারা সময়মতো ঋণের কিস্তির বাধ্যবাধকতা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।'

'কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া এসএমই খাত নানান শর্তের কারণে ঋণ পাচ্ছে না' বলে জানান তিনি।

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

Comments

The Daily Star  | English

Teacher candidates: Water cannons, batons used to disperse protesters

Despite police action, many protesters gathered near the High Court around 4:35pm

1h ago