ঝাল চাপ আর ঝরঝরে পোলাওয়ের মুক্তা বিরিয়ানি ঘর

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

খিলগাঁও রেলগেট থেকে রিকশা করে তিলপাপাড়া হয়ে গোড়ান যাওয়ার পথে পড়ে মুক্তা বিরিয়ানী ঘর। নাম বললে আশপাশের মানুষ থেকেও চিনে নিতে পারবেন। তবে এখন দোকান রয়েছে ২টি। ২ ভাই আকরাম খান ও আরমান খান চালাচ্ছেন ২ দোকান। এর ভেতর আদি দোকানটির দায়িত্বে আছেন আরমান। আকরাম একই নামে ভিন্ন জায়গায় দোকান চালাচ্ছেন।

গিয়েছিলাম আদি দোকানটিতেই। লাল অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে এর নাম। পুরো ঢাকাতেই চাপ-পোলাওয়ের জন্য খ্যাতি রয়েছে মুক্তা বিরিয়ানি ঘরের। এ ছাড়া, তাদের আস্ত কবুতর পোলাও ও ডাক রোস্ট পোলাওয়ের খ্যাতিও সুবিদিত।

তবে কবুতর ও হাঁসের আইটেম এখন বন্ধ আছে বলে জানালেন ক্যাশে বসা পিয়াস। এখন গরুর তেহারি, গরুর চাপ পোলাওয়ের মতো আইটেমগুলোই বেশি চলছে।

পিয়াস জানালেন, শীতের আগে থেকে আবার চালু হবে ডাক রোস্ট ও আস্ত কবুতর পোলাও।

আস্ত কবুতরের ভুনার স্বাদ নিতে না পারলেও সেটি খুব ভালোভাবেই পূরণ হয়ে গেল গরুর চাপ পোলাওয়ের সৌজন্যে। এক প্লেট সাদা পোলাও ও গরুর চাপের দাম ২০০ টাকা। পোলাও পরিমিত, ঝরঝরে। একজনের জন্য ঠিকঠাক। চাপের মাংসটি আকৃতিতে বেশ বড়।

সুসিদ্ধ মাংসের বড় টুকরোটি স্বাদের দিক থেকেও বেশ ঝাঁঝালো ঝাল স্বাদের। জানা গেল, মাংসে কাঁচা মরিচের বাটা ব্যবহার করা হয়। তাই ঝালটি মাংসে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে এই ঝাল মাংস বেশ চমৎকার রসায়ন তৈরি করে।

বাড়িতে বানানো ফিরনি। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

এর বাইরে বেশ কয়েকজনকে দেখা গেলো তেহারি খেতে। পিয়াস জানালেন, তেহারি দামে তুলনামূলক সুলভ। তাই অনেকেরই পছন্দ। তবে তাদের দোকানের সুখ্যাতির মূলে সেই বিখ্যাত চাপ পোলাও।

তিনি দোকানের ক্যাশে বসছেন ৭ বছর ধরে। আরও তথ্যের জন্য বললেন মহাজনের কথা। মহাজন বলতে আরমান খান।

দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন আরমানের বাবা নিজামুদ্দিন খান। সে বহু আগের কথা। ঢাকার গুলিস্তান থেকে কাছেই ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে ছিল তার ভাতের হোটেল। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, সবজি সবই মিলত সেখানে। ঝাল বেশি দিয়ে চমৎকার গরুর মাংস রান্নার জন্য খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে হোটেলটির।

এরপর ১৯৭১, শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ফুলবাড়িয়ার ওই অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প বসে। দোকানটি পুড়িয়ে দেয় তারা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আবার নতুন করে খাবারের ব্যবসা শুরু করার মতো পুঁজি তার ছিল না। তাই অন্য কিছু পেশায় ছিলেন নিজামুদ্দিন খান। দেখতে দেখতে কেটে গেল ১৫ বছর।

বর্তমান মূল্যতালিকা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

১৯৮৬ সালের দিকে তিনি ঠিক করলেন, আবার খাবারের ব্যবসাতেই ফিরবেন। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারির তীব্র শীতের ভেতর ঝাল করে রান্না করা গরুর চাপের মাংস আর পোলাও নিয়ে ছোট পরিসরে শুরু করলেন দোকান। সবচেয়ে ছোট মেয়ের নামে দোকানের নাম রাখলেন মুক্তা বিরিয়ানি ঘর।

শুরুতে এই একটি আইটেমই ছিল দোকানে। তারপর অন্যান্যগুলো আসে। কবুতর ভুনা ও পোলাও তুলনামূলক নতুন আইটেম। তবে শুরু থেকেই সাদা পোলাও ও চাপের জন্যই খ্যাতি পায় মুক্তা বিরিয়ানি ঘর।

তখন এটি ছিল টিনের চালা দেওয়া ছোট একটি দোকান। একবারে বসতে পারতেন ৭-৮ জন। কালক্রমে দোকানটি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন ভেতরে আছে ৬টি টেবিল। প্রতিটিতে ৪/৫ জন করে ২৪-৩০ জন বসতে পারেন একসঙ্গে। ক্যাশ কাউন্টারের বিপরীত দিকে থাকা সবুজ দেয়ালের এই ঘরটি আপনারা পেতে পারেন কোনো ক্যান্টিন বা সাবেকি আমলের কোনো ফুড কেবিনের ছাপ।

২০১৪ সালে প্রয়াত হন নিজামুদ্দিন। তারপর কিছুদিন একসঙ্গে থাকলেও পরে ২ ভাই আলাদাভাবে ব্যবসা করছেন। আরমান আদি দোকানটি দেখছেন। বড় ভাই আকরাম একই নামে অন্য জায়গায় দোকান শুরু করেছেন। তবে আরমানের দোকানটি চাপ পোলাও ও আকরামের দোকানটি তেহারির জন্য আলাদাভাবে খ্যাত।

দোকানে স্থানীয় মানুষের বাইরে পা পড়েছে খ্যাতিমান অনেকের। আরমান জানালেন, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল এখানে অনেকবার এসেছেন। সেই কিশোর বয়স থেকে এখনো তিনি এই চাপ পোলাওয়ের ভক্ত।

৯০ দশকে একবার আইয়ুব বাচ্চু তার ব্যান্ড এলআরবির সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন এখানে খেতে। চট্টগ্রামের ছেলে হওয়ায় আইয়ুব বাচ্চুর কাছে মেজবানি মাংসের মতো আইটেম ছিল সুপরিচিত। কাঁচামরিচ বেটে বেশি করে দেওয়া ঝালের এই চাপের স্বাদ নাকি অভিনব মনে হয়েছিল তার কাছে!

দোকান প্রতিদিন খোলা হয় দুপুর ১২টায়। খোলা থাকে রাত ১২টার কাছাকাছি পর্যন্ত।

পিয়াস জানান, রান্না সব হয় মহাজনের (আরমান খান) বাড়িতে। সেখান থেকে আসে। হোটেলে রান্নার ব্যবস্থা নেই।

রান্না করা হয় হিসাব করে। তাই খাবার নষ্ট হয় না। গরম গরম পরিবেশন করা হয়। মাংস সকালে রান্না করা হয়, দুপুরে নিয়ে আসা হয়। এরপর আরও কয়েক দফা গরম করে মাংস আনা হয়।

গরুর চাপটি নিজামুদ্দিন বেশ ঝাল করে রাঁধতেন। তার সেই রেসিপিই এখনো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা হয়। তবে তেহারি, ডাক রোস্ট ও আস্ত কবুতরের মাখো মাখো ভুনায় ঝাল খুবে বেশি দেওয়া হয় না বলে জানান পিয়াস।

গরুর মাংস তারা সাধারণত স্থানীয় বাজার থেকেই নেন। চাপ ও তেহারির জন্য আলাদাভাবে মাংস সাইজ করে নেওয়া হয়। এর বাইরে আছে তাদের নিজস্ব ফিরনি, জর্দা ও বোরহানি। সব আইটেম আরমান খানের তত্ত্বাবধানে বাড়িতে তৈরি। তাই হোটেলসুলভ আলাদা স্বাদ নয়, বরং এ থেকে বাড়ির খাবারের সতেজ স্বাদ পাওয়া যায় বলেই জানালেন তারা।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago