২০২২ সাল যেমন গেল বাংলাদেশের

২০২২ সালের বাংলাদেশ

করোনা মহামারির পর ২০২২ সালের শুরুতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ফিরে পেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাংলাদেশ। তবে, ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রবৃদ্ধির চাকা আবারও ধীর হয়ে যায়। ফলে, ২০২২ সাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জন্য একটি ঘটনাবহুল বছর।

বাংলাদেশের জন্য বছরটি কেমন ছিল তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।

পদ্মা সেতু: স্বপ্ন নয়, বাস্তব

চলতি বছরের ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই পদ্মাসেতু জাতির আত্মবিশ্বাস, উৎসাহকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা ও ২ সমুদ্রবন্দরকে (মংলা ও পায়রা) বাংলাদেশের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

শতভাগ বিদ্যুতায়ন

গত মে মাসে শতভাগ বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এই অর্জন বাংলাদেশকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ভারতে মোট জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ ও পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ বিদ্যুতায়ন হয়েছে।

তবে, এলএনজি ও পেট্রোলিয়ামের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পাওয়ায় সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। ফলে, জুলাই থেকে কয়েক মাস দেশবাসীকে তীব্র লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়।

৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ধরে রাখতে ব্যর্থতা

২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে রেকর্ড গড়লেও তা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। মহামারির পর থেকে অর্থনীতির চাকা পুনরায় সচল হলেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ আকাশছোঁয়া আমদানি ব্যয়ের তুলনায় কমে গেছে। যা এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন ১০০

২০২২ সালের শুরু থেকে ক্রমবর্ধমান আমদানির কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে। ফলে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার রেকর্ড দরপতন হয়। সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়ায়।

মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮০০ ডলার ছাড়িয়েছে

অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করলে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়, যা আগের বছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ ছিল।

খেলাপি ঋণ রেকর্ড সর্বোচ্চ

নন-পারফর্মিং লোন বা খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর শেষে রেকর্ড গড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট বকেয়া ঋণ ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

আইএমএফের কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে সরকার

জুলাইয়ে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর পাশাপাশি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ও বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে খাবার ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকট সামাল দিতে অনেক দেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টায় আছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানও আইএমএফের কাছে জরুরি তহবিল চেয়েছে।

২০১২ সালে, বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে সবচেয়ে বেশি ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। এটি ৩ বছরের বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধার অধীনে দেওয়া হয়েছিল।

পারমাণবিক শক্তিতে বড় অগ্রগতি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৯ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ও শেষ চুল্লির উদ্বোধন করেন। যা দেশটির প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার প্ল্যান্টটি ন্যূনতম ৬০ বছরের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত না করেই বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করবে।

ইসলামিক ব্যাংকের জন্য প্রথম স্বল্পমেয়াদী ঋণ

বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে 'ইসলামিক ব্যাংক লিকুইডিটি সুবিধা'র অধীনে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য প্রথম স্বল্পমেয়াদী ঋণ চালু করা হয়। ঋণদাতাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে আমানত উত্তোলন থেকে বেশ কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তারল্য চাপে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঋণ দেয়।

১১ বছরে মধ্যে প্রথমবার বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম

আগস্ট মাসে ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজিতে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২২ টাকা করেছে সরকার। শেষবার দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১১ সালের জুনে। তখন প্রতি কেজি ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছিল। এর ২ বছর পর দাম কমিয়ে ১৬ টাকা কেজি করা হয়।

নতুন করে বেড়েছে জ্বালানির দাম

ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির কয়েকদিন পর সরকার পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর ফলে জনরোষের সৃষ্টি হয়। পরে আমদানি খরচ কমে যাওয়ায় জনসাধারণের চাহিদার প্রেক্ষিতে দাম সামান্য কমানো হয়েছে।

২০২১ সালের নভেম্বরে, ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে ২৩ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করা হয়।

বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ১০৯ টাকা, পেট্রোল ১২৫ টাকা ও অকটেন ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রপ্তানি আয় বৃদ্ধি

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক বেশি। পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং পাট ও পাটজাত পণ্যসহ সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে এ বছর আয় বেড়েছে। এমনকি নভেম্বরে একমাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পোশাক খাতে ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলায় রপ্তানি আয় ছিল।

১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

ভোক্তা মূল্য, যা এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে ছিল- ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মে মাসে তা ৭ শতাংশের সীমা অতিক্রম করে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছে ১০ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে।

নভেম্বর পর্যন্ত গত ৩ মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে। এটি এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি আছে। যা জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বিশেষ করে নিম্ন ও সীমিত আয়ের পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

চালের দামে রেকর্ড

আগস্ট মাসে মোটা চালের দামও রেকর্ড গড়েছে। কারণ, প্রত্যাশার চেয়ে কম আমদানির কারণে সরবরাহের ঘাটতি ছিল। এছাড়া, মিল ও কৃষকদের কাছ থেকে ধীরগতিতে চাল পাওয়া গেছে। কারণ দেশের অনেক অংশে খরার মতো পরিস্থিতির কারণে আমন ধানের ফলন নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিল।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ঢাকায় চালের খুচরা দাম বেড়েছে প্রতি কেজি ৪৯.৫ টাকা, যা রেকর্ড সর্বোচ্চ।

গমের আটার চড়া দাম

চালের মতো, গমের আটাও ঢাকার বাজারে নভেম্বরে প্রতি কেজি ৬০ দশমিক ১১ টাকার রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। এর পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি হ্রাস, ভারত কর্তৃক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উচ্চ পরিবহন ব্যয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথমবারের মতো ১০০ টাকা ছুঁয়েছে চিনির কেজি

বিদায়ী বছরে অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে চিনির দাম প্রতিকেজি ১০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়েছে, যা ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিকেজি ৮০ টাকা ও এর কাছাকাছি ছিল। এজন্য শোধনাগারগুলো কাঁচা চিনি প্রক্রিয়াজাত করতে গ্যাসের চাপের সরবরাহকে দায়ী করেছে। পরে গ্যাস সরবরাহের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও ঢাকায় সুইটেনারের দাম বেড়ে প্রতিকেজি ১১৫ টাকা হয়েছে।

তবুও উদ্ধারকর্তা পোশাকখাত

সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ নিবন্ধিত পোশাক চালান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় দেখেছে বাংলাদেশ।

কিছু মাসের পোশাক চালানের আয় ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন- নভেম্বরে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। জানুয়ারি ও জুনের আয়ও উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বেশি ছিল- জানুয়ারিতে ৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার।

মেট্রোরেল চালু: গণপরিবহনে মাইলফলক

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রো রেলের সূচনা হয়। যা ঢাকা শহরের গণপরিবহনের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর মাধ্যমে ঢাকার যানজট কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রায় ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬-এ অনেক মানুষ একসঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শহরে যাতায়াত করতে পারবেন।

এর ফলে, ভারত ও পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মেট্রোরেল চালু হলো।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সোহেল পারভেজ, রেফায়েত উল্লাহ মৃধা ও সুকান্ত হালদার।

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

2h ago