গীতিকা রেকর্ডিং সেন্টার: হারিয়ে যাওয়া গানের ঠিকানা

ক্যাসেটের দোকান
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর সরু গলি দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ এক জায়গার সামনে থমকে দাঁড়ালাম, আর তা হলো একটা অডিও ক্যাসেটের দোকান। আমি ভেবেছিলাম এই দোকানগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। তবে দেখলাম একটি দোকান এখনও টিকে আছে।

গীতিকা রেকর্ডিং সেন্টার নামের এই দোকানটি ঢাকার প্রাচীনতম সংগীত বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর একটি। নুরুল হক মার্কেটের প্রথম তলায় অবস্থিত এই দোকানের ভেতরে পা রাখতেই মনে হলো যেন পুরোনো দিনে ফিরে গেছি।

সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু কিছু প্রতিধ্বনি কখনও মুছে যায় না। সিডি আর ক্যাসেট আমাদের এমন এক সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন চাইলেই স্ট্রিমিং করে গান শোনা যেত না। গান ছিল সংগ্রহ করার, হৃদয়ে অনুভব করার আর ভালোবেসে লালন করার মতো একটি ব্যাপার। পাটুয়াটুলী  এমন একটি জায়গা, যেখান থেকে একসময় ভেসে আসত গান, ছন্দ আর অডিও টেপে অমর হয়ে থাকা কালজয়ী কণ্ঠস্বর। বর্তমানে এর অধিকাংশ বিখ্যাত দোকান তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তবুও 'গীতিকা রেকর্ডিং সেন্টার' সেই সোনালী সময়ের শেষ প্রতীক হিসেবে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ।

ক্যাসেট
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

সত্তরের দশকে সঙ্গীতপ্রেমী সাদাসিধে মানুষ সন্তোষ কুমার রায় শুরু করেছিলেন এই দোকানটি। সে সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। প্রায়ই ঘুরতে যেতেন ক্যাসেটের দোকানে। পাটুয়াটুলীতে তার এক বন্ধুর ভাইয়ের দোকান ছিল, আর সেখানে তিনি কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেখান থেকেই শুরু হয় তার নিজের দোকানের পথচলা। বহু দোকান হারিয়ে গেলেও তার দোকানটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

স্মৃতি হাতড়ে সন্তোষ কুমার রায় বলেন, 'সেই সময় যদি কারো জামা কেনার দরকার হতো, সে চলে যেত নিউ মার্কেটে। কিন্তু গান রেকর্ড করতে বা কিনতে হলে আসতে হতো পাটুয়াটুলীতে। সে সময়ের সব শিল্পীই পুরান ঢাকার এই গলিগুলোতে হেঁটেছেন।'

তার মতে, নব্বইয়ের দশক ছিল পাটুয়াটুলীর স্বর্ণযুগ। মাঝে মাঝে এমন ভিড় হতো যে মানুষকে ফিরিয়েও দিতে হয়েছে অনেক সময়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, 'সেই দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। এখন তো কাস্টমারই আসে না।'

সন্তোষ কুমার রায় আমাকে কিংবদন্তি প্লেব্যাক সিংগার ও অভিনেত্রী সুরাইয়া জামাল শেখের একটি ভিনাইল রেকর্ড দেখান। তিনি 'সুরাইয়া' নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৫০ এর দশকের শুরুতে তিনি ছিলেন এক মহাতারকা।

'বেস্ট অব সুরাইয়া' নামের একটি রেকর্ড আমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, 'এখনও এই মাস্টারপিসটা আমার কাছে আছে।'

তার ভিনাইল সংগ্রহে আরও পুরোনো রেকর্ডও রয়েছে। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফির রেকর্ডের একটি সংগ্রহও দেখান আমাকে।

তিনি আরও বললেন, 'সঙ্গীত হলো মস্তিষ্কের খাদ্য। যত ব্যস্তই হোন না কেন, একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় সবারই দরকার হয়। তখন নিজেকে শান্ত এবং তরতাজা রাখতে সঙ্গীত প্রয়োজন। আজকাল সঙ্গীত খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে এবং এটা অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু এর ফলে এই প্রজন্মটা কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। আগে গ্রামোফোন ব্যবহার হতো, তখন একবারে দুটো গানই শোনা যেত। তাই গানকে মন দিয়ে শুনতে হতো, তার আবেগটাও গভীরভাবে অনুভব করতে হতো।'

দোকানটা ছোট মনে হলেও মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সাজানো ক্যাসেট প্লেয়ার, ডিভিডি, সিডি এবং পুরোনো অডিও রেকর্ডার দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন এক হারিয়ে যাওয়া সুরের জাদুঘর।

কৌতূহলী হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'এখনো কি মানুষ এগুলো কেনে?'

তিনি হেসে বললেন, 'আপনি অবাক হবেন। আমার মতো অনেক বয়স্ক মানুষ আজও রেকর্ড আর ক্যাসেট প্লেয়ার ইউটিউবের চেয়ে বেশি পছন্দ করেন। তারা বলেন, এইসব যন্ত্রের আওয়াজ অনেক শুদ্ধ, আর আবেগটা যেন বেশি বাস্তব লাগে।'

এরপর এখানে আমি শওকত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম, যিনি গত ২৬ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনি খুব যত্ন করে একটি পুরোনো বিয়ের ভিডিও সিডি থেকে রিস্টোর করছিলেন। তার পাশে বসে একজন গ্রাহক প্রতিটি দৃশ্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। জানলাম ওটা ছিল তার নিজের বিয়ের ভিডিও।

এই গ্রাহকের নাম ছিল প্রেমবাবু, বাংলা চলচ্চিত্রের পুরোনো একজন অভিনেতা। আশির দশকে 'ফাইটার' চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। তিনি তার অভিনীত পুরোনো সিনেমা 'দাগী' ও 'উসিলা'র সিডি খুঁজছিলেন, যা এখন প্রায় বিলুপ্ত।

ক্যাসেটের দোকান
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

 আরেকজন দর্শনার্থী ছিলেন আব্দুল হান্নান মুন্না, একজন বয়স্ক সংগীতপ্রেমী। হাতে লেখা একটি গানের তালিকা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এখনো ক্যাসেটেই গান শোনেন।

তিনি বলেন, 'ক্যাসেট প্লেয়ারের শব্দের একটা আলাদা ব্যাপার আছে। এই অনুভূতিটা আধুনিক ডিভাইসে মেলে না।'

দোকানে নানা ধরনের মানুষ আসেন। কেউ সংগ্রাহক, গবেষক, শিক্ষার্থী এবং কেউ কেউ পুরনো ক্যাসেটের রেকর্ডিং মেমোরি কার্ডে স্থানান্তরের জন্য আসেন। কেউ আসেন শুধুই স্মৃতি রোমন্থন করতে, আবার কেউ আসেন সেই স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করতে।

ক্যাসেট ও সিডির দাম সাধারণত ৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ১৫০০ টাকা বা তার বেশি পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান মো. জাবেদ। তিনি প্রায় ২৪ বছর ধরে দোকানটিতে কাজ করছেন।

সন্তোষ রায় গভীর আবেগ নিয়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৯০এর দশকের সংগীত নিয়ে কথা বলেন।

তিনি বললেন, 'ষাটের দশকটা ছিল স্বর্ণযুগ। সেই সময়েই আব্দুল আলিম আর আব্বাসউদ্দীন আহমেদের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা আমাদের গানের ধারা গড়ে তুলেছেন। এমন একটা সময় ছিল, যখন ঘরে ঘরে তাদের গান শোনা যেত। বিয়ের অনুষ্ঠানে কনে পক্ষের চিন্তা থাকত গান বাজানোর জন্য ভালো একটা স্পিকার যেন থাকে!'

গীতিকা রেকর্ডিং সেন্টার থেকে বের হওয়ার সময় সিঁড়ির ধাপে একটু থামলাম। মাঝে মাঝে ভাবি জীবনে সত্যিই একটা রিওয়াইন্ড বোতাম থাকলে মন্দ হতো না। কোনো ভুল যাওয়া গান, কোনো প্রিয় জায়গায় ফিরে যাওয়া যেত। পেছনে তাকিয়ে দেখি দোকানটা যেন মৃদুস্বরে বলছে, 'কিছু কিছু জিনিস এতটাই সুন্দর যে ভোলা যায় না, তাই না?'

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Mahfuj Alam apologises for past 'divisive' statements

"The patriotic people who stood united during the July uprising now face a long test"

1h ago