বিদেশে উচ্চশিক্ষা: ফাইল খুলছে না ব্যাংকগুলো, অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) থেকে স্নাতক শেষ করেছেন মোহাম্মদ ওমর ফারুক (২৭)। যুক্তরাজ্যে স্নাতকোত্তর করার আশা তার।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্র্যাটেজিক পিপল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর করার জন্য অফার লেটার পেয়েছেন ফারুক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও শেষে এসে তিনি একটি বাধার সম্মুখীন হন। তা হলো— যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি জমা দেওয়ার জন্য একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা। কারণ, ব্যাংকগুলো তার জন্য একটি প্রোফাইল খুলতে অনিচ্ছুক।
চলমান অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন তাকে ২০২৪ সালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 'আমি আমার জীবন থেকে একটি বছর হারাচ্ছি। এর দায় কে নেবে?', দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন ওমর ফারুক।
দেশের ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে থাকায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন ফারুকের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী, যারা বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন।
চলতি বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'এটি একটি সাময়িক সমস্যা এবং শিগগিরই এর সমাধান করা হবে।'
ডেইলি স্টার অন্তত ৭ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে, যারা এখনো এই সমস্যা অবসানের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ব্যাংকে ফাইল খোলার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের চেষ্টা করেছেন ফারুক। তিনি প্রিমিয়ার, ইউসিবি, প্রাইম, সিটি, ব্র্যাক, এইচএসবিসি ও ঢাকা ব্যাংকের রাজধানীর বেশ কয়েকটি শাখায় গিয়েছেন। কিন্তু, তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। সবশেষে এক প্রবাসী বাংলাদেশির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ৩ হাজার পাউন্ড পাঠানোর চেষ্টাও করেন ফারুক। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। কারণ যে ব্যক্তি টাকা পাঠাবে, তিনি শিক্ষার্থীর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় হতে হবে।
রাজধানীর আরেক শিক্ষার্থী মাশরাফি আহমেদ (২০) হাঙ্গেরির কোডোলানি ইয়ানোস বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক করার জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। নভেম্বরে তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংকের পান্থপথ শাখায় একটি ফাইল খুলতে যান। কিন্তু, খুলতে পারেননি।
মাশরাফি বলেন, 'এখন আমি কী করতে পারি? হাঙ্গেরিতে আমার পরিচিত এমন কেউও নেই যে বিকল্প কোনো উপায়ে টাকা পরিশোধ করতে পারবে।'
চলতি বছর কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা রিফাত আহমেদ (২০)। কিন্তু, গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি পরিশোধ করতে পারেননি।
'মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড আমাকে জানিয়েছে যে ডলার সংকটের কারণে তারা ফি দিতে পারবে না', বলেন তিনি।
অন্যদিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার শিক্ষার্থী নিশীত জামান (২০) ইতোমধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকে একটি স্টুডেন্ট ফাইল খুলেছে। কারণ ব্যাংকটি তাদের শাখার মাধ্যমে টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু, ব্র্যাক ব্যাংক এখনো ফি দিতে পারেনি, যদিও নিশীতের ফি দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়ে আসছে। ডিসেম্বরে তার সময়সীমা শেষ।
গত ২ বছর ধরে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিশীত। তিনি বলেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য একটি দীর্ঘ যাত্রার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। যদি তা বাতিল হয়ে যায়, তবে এটি আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য হতাশাজনক হবে।'
নতুন প্রোফাইল খোলার জন্য আরও ৩টি ব্যাংকে গিয়েছিলেন নিশীত। কিন্তু সেই ব্যাংকগুলোও বর্তমান ডলারের সংকটের কথা উল্লেখ করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়।
এর আগে গুজব রটেছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শিক্ষার্থীদের ফাইল না খোলার নির্দেশ দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এ ধরনের কোনো আদেশ দেইনি। আমরা কেবল তাদেরকে পর্যাপ্ত তহবিল ও সক্ষমতার ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি।'
'যে ব্যাংকগুলো নতুন ফাইল খুলতে পারছে না, সেগুলো তহবিল সংকটের মুখোমুখি হতে পারে', যোগ করেন তিনি।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ফয়েজ উদ্দিন সরকার বলেন, 'চলমান ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় আমরা সমস্যায় পড়েছি।'
তবে, জানুয়ারির মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'ডলারের সংকটের কারণে প্রোফাইল খোলার জন্য আমাদের ব্যাংক একটি রক্ষণশীল পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যদিও প্রতি মাসে আমাদের ব্যাংক সাধারণ ৩০ থেকে ৪০টি অ্যাকাউন্ট খুলে থাকে, কিন্তু, এখন ৫ থেকে ৬টির বেশি খোলা হচ্ছে না।'
'আমরা এটা পুরোপুরি বন্ধ করিনি। গুরুত্বের ভিত্তিতে আমরা অ্যাকাউন্ট খুলছি। উদাহরণস্বরূপ: যদি কোনো শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড বা হার্ভার্ডে যেতে চায়, তবে সেই ফাইলটি আমরা অবশ্যই খুলি', বলেন তিনি।
তবে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
এসসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলা বন্ধ করিনি। বরং আমরা গত বছরের তুলনায় তা দ্বিগুণ করেছি। এ ছাড়া, আমরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সহায়তা জন্য ডেডিকেটেড ডেস্ক স্থাপন করেছি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা সংক্রান্ত সেবার জন্য ৪১৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিদেশে পাঠানো হয়।
ইউনেস্কোর 'গ্লোবাল ফ্লো অব টার্শিয়ারি স্টুডেন্টস' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ত্যাগ করেছেন।
সিটি ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'গত অর্থবছরে সিটি ব্যাংক শিক্ষার্থীদের ফাইল খোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও এখন ভর্তির সময়, কিন্তু, আমরা এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সাহায্য করতে পারছি না।'
ঢাকা ব্যাংকের রিটেইল বিজনেস ডিভিশন এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকা ব্যাংক স্টুডেন্ট ফাইল সেবা চালু রেখেছে। এখন পর্যন্ত ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৩ গুণ বেশি শিক্ষার্থীদের আমরা এ সেবা প্রদান করেছি এবং এ সেবা চলমান আছে। কেউ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এমন কোনো খবর আমাদের কাছে সরাসরি বা কল সেন্টারে মাধ্যমে আসেনি।'
চলমান এই সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার বিষয়টি এক ধরনের শঙ্কার মধ্যেই রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের সুযোগ আর পাবেন না বলে মনে করছেন।
Comments