ডলার সংকটে কমেছে ফল আমদানি, কমলা চাষে লাভবান কৃষক
রংপুরের পাঁচ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফমারীর বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠা কমলা ও মালটার বাগান থেকে ভালো মুনাফা পাচ্ছেন কৃষক।
গেল ৫-৬ বছর ধরে এসব বাগানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে কমলা।
এ অঞ্চলের উৎপাদিত কমলা ও মালটা আকারে ছোট হলেও স্বাদে অতুলনীয়। এসব কমলা ও মালটা দামে তুলনামূলক কম হওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর চাহিদাও অনেক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় প্রায় ৪০০ একর জমির ওপর ১০৮টি কমলা ও মালটা ফলের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে আছে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার গাছ। প্রতিবছর এসব বাগান থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন কমলা ও মালটা উৎপন্ন হচ্ছে। এসব বাগানে চায়না, দার্জিলিং ম্যান্ডারিং ও দার্জিলিং নাগপুরি জাতের কমলা ও মালটা গাছ রয়েছে। এসব বাগানে শ্রমিকসহ যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ মুনাফা করতে পারছেন চাষিরা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার হাড়িভাঙ্গা এলাকার কৃষক এনামুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি আট একর জমিতে ২ হাজার ৬০০ মালটা ও কমলা গাছ লাগিয়েছিলেন। গেল চার বছর ধরে তিনি এসব গাছ থেকে ফলন পাচ্ছেন। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ৪০ কেজি ফলন আসছে। বাগান থেকে তিনি প্রতিকেজি কমলা ও মালটা বিক্রি করছেন ১০০ টাকা দরে। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ফল বিক্রেতারা তার বাগান থেকে কমলা ও মালটা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
'প্রতিবছর বাগানের পরিচর্যার জন্য শ্রমিক খরচসহ অন্যান্য খরচ বাবদ আমাকে ৪০-৪২ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। প্রতিবছর আমার বাগানে উৎপাদিত কমলা ও মালটা বিক্রি করে পাচ্ছি এক কোটিরও বেশি টাকা,' বলেন এনামুল।
এনামুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গেল বছর এসময়ে তিনি বাগান থেকে প্রতিকেজি কমলা ও মালটা ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন কিন্তু এবছর তা বিক্রি করছেন ১০০ টাকা দরে।
কমলা আর মালটার বাগানে আদার চাষ করে বাড়তি মুনাফা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সুজনেরজুটি গ্রামের কৃষক আবু বক্কর বলেন, তিনি ১৩৫টি গাছ নিয়ে ২০২০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষ করছেন। তিনি দার্জিলিং ম্যান্ডারিন জাতের কমলা উৎপন্ন করছেন। তিনি ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছেন এবং আরও এক লাখ টাকার কমলা বিক্রি করতে পারবেন।
'বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষ করে আমি লাভবান হয়েছি। আমার সফলতা দেখে স্থানীয় কৃষকরাও উৎসাহী হচ্ছেন।'
'চলতি বছর ২০০টি কমলার গাছ লাগিয়ে আরও একটি বাগান গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছি,' বলেন তিনি।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খতা গ্রামের কৃষক খলিলুর রহমান জানান, আট বছর আগে তিনি ৫ বিঘা জমিতে ৪৫০টি দার্জিলিং ম্যান্ডারিন ও দার্জিলিং নাগপুরি জাতের কমলার গাছ লাগিয়েছিলেন। গেল চার বছর ধরে তিনি এসব গাছ থেকে কমলার ফলন পাচ্ছেন। প্রতিবছর তিনি কমলা বিক্রি করে ৬-৭ লাখ টাকা আয় করছেন।
'আমি নিজেই কমলা বাগানের পরিচর্যা করি। কমলা ও মালটা চাষ আমাদের জন্য লাভজনক,' তিনি বলেন।
'আমাদের এখানে উৎপাদিত কমলার সাইজ একটু ছোট হলেও স্বাদ ভালো।'
লালমনিরহাট শহরের ফল ব্যবসায়ী আরশাদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা স্থানীয় বাগান থেকে প্রতিকেজি কমলা ও মালটা ১০০ টাকা দরে কিনে তা ১৪০-১৫০ টাকা দরে খুচরা বিক্রি করছেন। আমদানিকৃত ফলের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলের দাম কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এই ফল বেশি কিনছেন।
'স্থানীয় বাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মালটা ও কমলার চাহিদা ব্যাপক রয়েছে কিন্তু চাহিদামতো সরবরাহ পাচ্ছি না। আমি প্রতিদিন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ২০০-২৫০ কেজি কমলা ও মালটা বিক্রি করছি,' তিনি বলেন।
রংপুর শহরের ফল ব্যবসায়ী সুনীল চন্দ্র সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা বাগানগুলো থেকে কমলা ও মালটা কিনে আনেন। এসব কমলা ও মালটা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।
'আমি প্রতিকেজি কমলা ও মালটায় ৫-৭ টাকা লাভ করছি। খুচরা বিক্রেতারা প্রতিকেজিতে লাভ করছেন ৩০-৩৫ টাকা।'
রংপুরে ফলের দোকানে ফল কিনতে আসা আশরাফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা ও মালটা ১৩০-১৫০ টাকা কেজিদরে কিনতে পারছেন। আমদানিকৃত ফল কিনতে হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা কেজি দরে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা ও মালটার সাইজ একটু ছোট হলেও স্বাদে তেমন পার্থক্য নেই।
'স্থানীয়ভাবে কমলা ও মালটা উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সররাহও বেড়ে যাবে। এতে আমরা আরও কমদামে ফল কিনতে পারব,' তিনি বলেন।
ডলার সংকটের কারণে বিদেশি ফলের আমদানি কমেছে জানিয়ে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের ফল আমদানিকারক শামিম আহমেদ খান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গেল বছরের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কম ফল আমদানি করেছেন তিনি এবার। ডলার সংকটের কারণে আমদানিকারকরা ফল আমদানি করতে পারছেন না। এ কারণে বাজারে আমদানিকৃত ফল বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ফল আমদানি কম হওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা ও মালটার চাহিদা বেড়েছে।
'আমি নিজেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কমলা ও মালটা কিনেছি,' তিনি বলেন।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপারিচালক হামিদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দিনদিন কমলা ও মালটা ফলের চাষ বাড়ছে। এসব ফল চাষে অনেক কৃষক আগ্রহ প্রকাশ করলেও অধিক পুঁজি লাগার কারণে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। 'আমাদের অঞ্চলের মাটি বেলে-দোআঁশ হওয়া কারণে তা কমলা ও মালটা চাষে উপযোগী। এসব ফলের গাছ লাগিয়ে কৃষকরা সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে তারা আশানুরূপ ফল পাবেন।'
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমলা ও মালটা ফলের বাগান কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক আফতাব হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এখন যেসব কমলা ও মালটা বাগান থেকে ফল উৎপাদিত হচ্ছে এসব বাগানে গাছ লাগানো হয়েছিল ৮-১০ বছর আগে। একযুগ আগে এ অঞ্চলে কমলা ও মালটা ফল উৎপাদন করা একটা স্বপ্নের বিষয় ছিল। সেসময় কিছু সৌখিন মানুষ বসতভিটায় ২-৪টি কমলা ও মালটা গাছ লাগিয়ে ফলন পেয়েছিলেন। সেখান থেকে উৎসাহী কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে কমলা ও মালটা ফল উৎপাদনের অনুপ্রেরণা পান। 'বর্তমানে অনেক কৃষকই বাণিজ্যিকভাবে কমলা ও মালটা উৎপন্ন করে সফলতা পাচ্ছেন। উৎপাদিত এসব স্থানীয়ভাবে ফলের চাহিদা যেমন মেটাচ্ছে তেমনি ফল উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।'
তিনি বলেন। 'আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে কমলা ও মালটা ফলের চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।'
Comments