অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার কেন হয়, লক্ষণ ও চিকিৎসা কী

দেরিতে শনাক্ত হওয়া ক্যানসারের মধ্যে অগ্ন্যাশয় ক্যানসার অন্যতম। যে কারণে এই ক্যানসারে বেঁচে থাকা এবং সুস্থ হওয়ার হারও অনেক কম।
অগ্ন্যাশয় ক্যানসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড মালিবাগ শাখার কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার কী
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মানবদেহে পাকস্থলীর ঠিক পেছনেই প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের অবস্থান। অগ্ন্যাশয় দুটি বিশেষ কাজ করে। যেমন- খাদ্য গ্রহণের পর খাবার হজমের জন্য যে রস বা এনজাইম প্রয়োজন হয় সেই এনজাইম তৈরিতে কাজ করে অগ্ন্যাশয়। এছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য একটি হরমোন দরকার হয় সেটি হচ্ছে ইনসুলিন, যার অভাবে ডায়াবেটিস হয়। এই ইনসুলিন তৈরি করে অগ্ন্যাশয়।
অগ্ন্যাশয় ক্যানসার হলো অন্য সব ক্যানসারের মতই অনিয়ন্ত্রিত কিছু সেলুলার অর্থাৎ কোষের পরিবর্তনজনিত বিস্তার। অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হলে এক ধরনের চাকা বা টিউমার গঠিত হয়, যা ক্যানসারে পরিণত হতে পারে।
এটাই একমাত্র টিউমার যা ক্যানসারে পরিণত হলে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫ বছর বেঁচে থাকার হার শতকরা ৭ ভাগ। অত্যন্ত হতাশাজনক ও মারাত্মক রোগ হচ্ছে প্যানিক্রিয়াটিক বা অগ্ন্যাশয় ক্যানসার, কারণ এর কোনো নিজস্ব উপসর্গ নেই যার মাধ্যমে চিকিৎসক বুঝতে পারবেন অগ্ন্যাশয় ক্যানসার হয়েছে।
সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের অগ্ন্যাশয় ক্যানসার হয়। এই বয়সী মানুষের পেটে ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা, পিত্তথলিতে পাথর বা অন্য কোনো কারণে ব্যথা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। অগ্ন্যাশয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে এই বিষয়টি মাথায় আসে না। এমনকি অগ্ন্যাশয়কে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ করায় চিকিৎসকের মনোযোগের ঘাটতির কারণে অনেক সময় প্যানক্রিয়াসে কোনো রোগ থাকলেও সেটি সঠিকসময়ে শনাক্ত হয় না। অতএব রোগটি দেরীতে শনাক্ত হয়, যার কারণে অগ্ন্যাশয় ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।
অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার কেন হয়
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার কেন হয় তার সরাসরি কারণ জানা যায়নি। তবে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোর কারণে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। যেমন-
১. ধূমপানের কারণে অগ্ন্যাশয় ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
২. অ্যালকোহল গ্রহণ করেন যারা তাদেরও ঝুঁকি বেশি। অ্যালকোহল সেবনের কারণে প্রাথমিকভাবে অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের ফলশ্রুতিতে অগ্ন্যাশয় ক্যানসার হতে পারে।
৩. ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. সাধারণত ৪০ বছরের বেশী বয়সীরাই আক্রান্ত হয়।
অগ্ন্যাশয় ক্যানসারের ধরন মূলত একটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাডিনোকার্সিনোমা ক্যানসার হয়। আরেকটি ধরন হচ্ছে নিউরোঅ্যান্ডোক্রাইন ক্যানসার, যা খুবই বিরল।
লক্ষণ
১. দীর্ঘমেয়াদী পেটে ব্যথা
২. ওজন কমে যাওয়া
৩. জন্ডিস, চোখের সাদা অংশে হলদে ভাব
৪. মলের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
৫. পেট ভরা ভরা লাগা
এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্যানক্রিয়াসে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, ক্যানসার আছে কিনা তা শনাক্ত করে চিকিৎসা নিতে হবে। দ্রুত শনাক্ত হলে অগ্ন্যাশয় ক্যানসার রোগীদের বেঁচে থাকার হার ৭% এর বেশি বাড়ানো যাবে।
রোগ নির্ণয়
অধ্যাপক স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পেটে ব্যথা, ওজন কমে যাওয়া, পেট ভার ভার লাগা, জন্ডিস, মলের রঙ ফ্যাকাশে হয়েছে এসব উপসর্গ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। অগ্ন্যাশয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না বা ক্যানসার আছে কি না তা শনাক্তের জন্য প্রথমেই রোগীর সম্পূর্ণ পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে। সেখানে প্যানক্রিয়াসে বা গলব্লাডারে কিছু পরিলক্ষিত হলে পেটের সিটি স্ক্যান করতে হবে।
একইসঙ্গে কিছু রক্ত পরীক্ষাও করতে হবে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে চেক করা যায় বিশেষ একটি মার্কার হচ্ছে CA 19.9 (Cancer Antigen 19.9)। রক্তে যদি এটি বাড়তি পাওয়া যায় তাহলে অগ্ন্যাশয়ে কোনো সমস্যা আছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এসব পরীক্ষার পাশাপাশি যদি রোগীর জন্ডিস থাকে তাহলে এমআরসিপি পরীক্ষা করতে হবে। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে টিউমারের বৃদ্ধি কতখানি সেটি জানা যাবে।
অগ্ন্যাশয়ের তিনটি ভাগ রয়েছে। যেমন- মাথা, বডি ও লেজ। অগ্ন্যাশয়ে ক্যানসার আছে কি না তা শনাক্ত করার জন্য এর বায়োপসি করতে হবে। দুইটি উপায়ে বায়োপসি করা যেতে পারে। যেমন- ডিরেক্টলি ইমেজ গাইডিং বায়োপসি পদ্ধতি যেখানে আলট্রাসনোগ্রাম বা সিটি স্ক্যান মেশিনের নিচে রোগীকে রেখে টিউমার বা সন্দেহজনক টিস্যুতে সূঁচ ঢুকিয়ে বায়োপসি করা হয়।
দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে ইআরসিপি এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিওপ্যানক্রিটোগ্রাফি (ইআরসিপি)। ইআরসিপির মাধ্যমে চিকিৎসক বায়োপসি করে টিস্যু নমুনা সংগ্রহ করেন যা অগ্ন্যাশয় ক্যানসার নির্ণয়ে সহায়তা করে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অন্যান্য ক্যানসারের মতোই দেখতে হবে অগ্ন্যাশয় ক্যানসারের বিস্তৃতি কি বহুদূর নাকি সীমাবদ্ধ? ক্যানসার অগ্ন্যাশয়ের বডিতে, হেডে, লেজে যদি বিস্তৃত হয় সেক্ষেত্রে একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এবং হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন রোগীকে কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে।
ক্যানসারের ধরন ও পর্যায়ের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হবে রোগীকে। অগ্ন্যাশয় ক্যানসার যদি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হয় তাহলে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এ ছাড়া কেমোথেরাপি, কখনো টার্গেটেড থেরাপি, মুখে খাওয়ার ওষুধ, রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় রোগীকে।
অগ্ন্যাশয় ক্যানসার প্রতিরোধ সচেতন হতে হবে। ধূমপান, অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে, ওজন কমাতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, ফলমূল, শাকসবজি খেতে হবে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে।
Comments