বিদেশে উচ্চশিক্ষা: সপ্তাহ হিসেবে কাজের পরিকল্পনা
উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে আমরা যারা নিজের পরিবার ছেড়ে একাই পাড়ি জমাই, তাদের জন্য শুরুর দিকটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হলো সব ধরনের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা। এই কাজের মধ্যে থাকে পড়াশোনা থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষে পড়ানো, গ্রেডিং এবং ঘরের নিত্যদিনের কাজগুলো। তাই প্রথম সেমিস্টারের একটা ভালো সময় চলে যায় সবকিছু গুছিয়ে উঠতে। এ কারণে শুরুর এই সময়টা 'আমাকে ভালো করতেই হবে' এমন মানসিকতায় না থেকে নতুন পরিবেশে নিজেকে সময় দিয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময়।
অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আগেই গুছিয়ে নেওয়া
বাইরের দেশগুলোয় প্রতিটা সেমিস্টারে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়। আগামী ৪ মাস কীভাবে কী করা হবে, কবে কুইজ আর কবে টার্ম পেপার সাবমিশন, সবকিছুর তালিকা আগেই শিক্ষার্থীকে দিয়ে দেওয়া হয়। তাই অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার পাওয়ার পরেই গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন যে কীভাবে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থী যাদের শ্রেণিকক্ষে পড়াতে হবে, এই প্রত্যেকটা শিডিউল কী হবে। এরপর থাকে ঘরের প্রয়োজনীয় কাজগুলো। সাধারণত সেমিস্টার চলাকালীন এত ব্যস্ততা থাকে যে সপ্তাহে সময় পাওয়া যায় খুব কম। আর একা মানুষ হলে তো কথাই নেই! বাজারসদাই, লন্ড্রি, গাড়ি ওয়ার্কশপে নেওয়া সবকিছুই নিজেকে করতে হয়। সেক্ষেত্রে সপ্তাহ হিসেবে কাজের তালিকা তৈরি করে রাখা যেতে পারে। যেমন প্রতি উইকেন্ডে লন্ড্রি, মাসের কোন দুসপ্তাহে বাজার, সপ্তাহের কোন দিনগুলো জিমে যাওয়া হবে সেগুলো আগেভাগেই ঠিকত করে নেওয়া যায়।
এ ছাড়াও বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই কিছু ক্লাব, অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সেখানে প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজগুলো সময়ের মধ্যে করাটা বেশ দায়িত্বশীলতার মধ্যেই পড়ে। আবার যেহেতু বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা থাকেন তাই প্রত্যেকের সুবিধাজনক সময় ভিন্ন হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। তাই প্রত্যেকের সঙ্গে আলোচনা করে অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন আয়োজনসহ এসবের পরিকল্পনা, সপ্তাহের মিটিং কোন দিন হবে সবকিছুই ৭ দিন কিংবা ১৪ দিন ধরে পরিকল্পনা করে নেওয়া সুবিধাজনক।
একেবারে দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা না করে সপ্তাহ ধরে করে রাখার কারণটা হলো, অনেক সময়ই দেখা যায় আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখলেও হুট করেই নতুন কোনো কাজ চলে আসছে যার জন্য হয়তো কয়েকদিনের কাজের তালিকাটাই পরিবর্তন করতে হয়।
খাবার এবং রান্নার নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা
দেশীয় খাবার রান্নায় যে ভালো একটা সময় ব্যয় হয়, বুঝতে পেরেছিলাম নানা ব্যস্ততায় যখন রান্না করতে হতো। তাই আমি নিজে বেশিরভাগ চেষ্টা করতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং থেকে খেয়ে নেওয়ার। এতে আসলেই অনেকটা সময় বেঁচে যায়। আমেরিকার সংস্কৃতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ওখানে প্রায় প্রত্যেকেই খাবার 'টু গো' করে বাড়িতে নিয়ে আসে। তাই ডাইনিংসহ কোন রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে আলাদা মিল ডর্মে নিয়ে আসতাম।
তারপরেও নিজস্ব দেশি খাবারের চাহিদা থাকবেই। তাই মাসের বাকি দিনগুলো আগেই হিসেব করে রাখতাম কী ডিশ রান্না করব আর কবে রান্না করব। সাধারণত উইকেন্ড সকাল থেকেই রান্না শুরু হতো এবং এমন কিছু রাঁধা হতো যা দুদিন রেফ্রিজারেটরে রেখে খাওয়া যায়। অনেক সময় খাবারের গুণাগুণ কিছুটা নষ্ট হবে, তাই খাবারের সঙ্গে স্যালাড কিংবা দ্রুত এয়ারফ্রায়ার বা ওভেনে বেক করে নেওয়া যায় এমন খাবার থাকত সাইড ডিশ বেশিরভাগ সময়ই।
কেনাকাটায় অনলাইন সাবস্ক্রিপশন
বেশকিছু অনলাইন সাবস্ক্রিপশন নেওয়া থাকলে যাতায়াতের সময়টাও বেঁচে যায়। আমেরিকায় নিজস্ব গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করাটা বেশ ঝামেলার। সব মিলিয়ে এসব ঝামেলা এড়ানো যায় অনলাইনে সাবক্রিপশন নেওয়া থাকলে। বাজার কখন পৌঁছে দেবে, সে সময়টাও নিজ সুবিধানুযায়ী ঠিক করা যায়। আরেকটি সুবিধা হলো, অনলাইনে কোনো পণ্য ভালো না হলে হেল্পলাইনে যোগাযোগ করলে সেটা রিফান্ড করে দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও যে বিষয়টার কথা আসলেই বলতে হয় সেটা হলো, নতুন আমাদের মতো যেসব শিক্ষার্থী আছেন তাদের জন্য খুব উপকারী একটা বিষয় নিজ দেশের অন্যান্য শিক্ষার্থী বা প্রবাসীদের সঙ্গে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ। যেমন কেন্টাকিতে গ্র্যাডহাউজিংয়ে আমরা যারা ছিলাম, আমাদের নিজেদের এরকম কয়েকটি গ্রুপ ছিল। যাদের গাড়ি আছে কিংবা কেউ কোনো নির্দিষ্ট দোকানে যাচ্ছে তা আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো গ্রুপগুলোর মাধ্যমে। আমরা সহজেই নিজেদের প্রয়োজনীয় কী আনতে হবে জানিয়ে দিতাম।
শুধু কেনাকাটার ক্ষেত্রেই নয়, কোনো দাওয়াত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আয়োজনে যেতে হবে কিন্তু ঠিকানা বেশ দূরে— এসব ক্ষেত্রেও যাতায়াতের জন্য এমন সহযোগিতা পেয়েছি অন্যান্য শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের থেকে। কখনো হয়তো তুষারঝড় হবে কিংবা অসুস্থ, এমন সব সময়েও নিজেদের খোঁজ নেওয়ার জন্য এসব গ্রুপ বেশ সুবিধাজনক। আবার কখনো দেখা গেছে যে, বাজারসদাইয়ের সাবস্ক্রিপশন ফি বেশি হলে ডর্মের দু-তিনজন মিলেও একই সাবস্ক্রিপশন ব্যবহার করেছি আমরা। আর এই সহযোগিতাটুকু থাকে বলেই নতুন এক দেশে যাত্রাপথ অনেকটাই নির্ভার হয়।
নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।
Comments