‘বন্যার পানি নাইমছে, কিন্তু জীবন তছনছ করি গেছে’

মরিয়ম আক্তার ও রুনা রানী দাস। ছবি: স্টার

'কিছু বুইঝবার আগাদি রাইতের বেলা আচমকা ঢলের পানি ঘরে ঢুকে। হেসমকা কিছু কি আর বার করণ যায়নি। আন্ডা ছয় ঘরের লোক পাশের একতলার দালানের ছাদে যাই উডি। হেতারা হে সময় হেনী। খানাদানা কিচ্ছু নাই। হেডে বোখের লাই চক্ষে আন্ধার দেখছিলাম।'

বন্যার পানির তীব্র স্রোতের বিপরীতে তিনদিন টিকে থাকার লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন পরশুরামের সাতকুচিয়া গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব নারী মরিয়ম আক্তার। চোখে মুখে তার এখনো আতঙ্কের ছাপ।

তিনি জানান, প্রচণ্ড ক্ষুধার তাড়নায় একপর্যায়ে মাছের খাবারের ড্রামে করে  ভাসতে ভাসতে তারা ওঠেন পরশুরাম পাইলট হাইস্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে যাওয়ার পর খাবার পান।

ভেজা চোখে তিনি বলেন, 'তিনদিন কিছুই খাই ন। একদিকে হেডের বোক, আরেকমুই বোকে দুই নাতি কান্দের! নিজে বুইজলেও, হেগুন রে তো আর বুজ দিতাম হারি ন।'

মরিয়মের কথা টেনে নিয়ে তার প্রতিবেশী রুনা রানী দাস বলেন, 'ঘরে সে সময় এক মানুষ সমান পানি। ঘরে চাইল-ডাইল যা ছিল সব পানির নিচে।  তিনদিন এভাবেই ছিলাম। একসময় বুদ্ধি করে মাছের খাবারের ড্রাম ধরে ভাসতে ভাসতে স্রোতের মধ্যে তিন ঘণ্টায় পরশুরাম পাইলট স্কুলে পৌঁছাই। তিনদিন পর পেটে কিছু খাবার পড়ে।'

মরিয়ম ও রুনা রানী দাসের মতো প্রাণ বাঁচাতে খাবারের জন্য বন্যার প্রবল স্রোতের মাঝেও এভাবে ভাসতে ভাসতে উপজেলা সদরে গিয়েছিলেন ফেনীর পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের সাতকুচিয়া গ্রামের বাসিন্দারা।

গতকাল সোমবার সাতকুচিয়ায় দেখা যায়, সড়ক ও বাড়িতে ঢোকা বন্যার পানি সরে গেছে। তবে জায়গায় জায়গায় রেখে গেছে স্রোতের ঢলের ধ্বংসযজ্ঞ। জমাটবদ্ধ কাদা জানান দিচ্ছে বন্যার চিহ্ন। সড়কের কোথাও কোথাও বড় গর্ত।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে বন্যার ভয়াল দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানান গ্রামবাসী। তাদের কথায় ফুটে ওঠে অনাগত দিনগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তার ভয়।

রুনা রাণী বলেন, 'বন্যায় ঘরের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে থাকা কাপড়চোপড় সব পানি আর কাদায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুধু গায়ের পোশাকটাই একমাত্র সম্বল।'

তার স্বামী দর্জির কাজ করেন। বন্যা পরিস্থিতিতে তার কোনো আয় হয়নি। কবে নাগাদ আবার কাজ শুরু করতে পারেন সেটাও অনিশ্চিত। এখন কীভাবে তাদের সংসার চলবে তা ভেবে দিশেহারা রুনা।

মরিয়ম আক্তার জানান, তিনি একটি এনজিও থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ির একপাশে বীজতলা করেছিলেন। কয়েকদিন পরেই সেখান থেকে ধানের চারা বিক্রি করার কথা ছিল তার। কিন্তু বন্যায় সব ভেসে গেছে।

আক্ষেপের সুরে মরিয়ম বলেন, 'গেল মসুমে জালা বইয়াইছিলাম। হেবার দাম উডে ন। এবার ১৫ হাজার টেয়া এনজিওর তুন ঋণ করি জালা বইয়াই ছিলাম। কদিন বাদে তুলি বেচমু। কিন্তুক বানের হানি তো বেক শেষ করি দিছে।'

কথা বলতে বলতেই নিজের ঘরটি দেখান মরিয়ম। পানির স্রোতে ঘরের বেড়া ও টিন ফুটো হয়ে গেছে। যেকোনো ঘরটি ধসে পড়তে পারে।

মরিয়মের মতো একই অবস্থা গ্রামটির অনেক বাসিন্দার।

মরিয়মের ঘর পানির স্রোত মোকাবিলা করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, সীমান্তবর্তী গ্রামটির অনেক মানুষের ঘর পুরোপুরি ভেসে গেছে। তবে এসব বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, তারা পরশুরামের অন্যত্র আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন।

ঋণ নিয়ে বর্গা জমিতে বেগুন ও পুঁইশাকের আবাদ করেছিলেন দিনমজুর শরাফত উল্লাহ। বন্যায় তার সবজি খেত ভেসে গেছে। পানির স্রোতে ভেঙে গেছে ঘরের একাংশও।

এখন ঋণ পরিশোধ আর ঘর ঠিক করার পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় শরাফত।

তিনি বলেন, 'সামনের দিনে কিয়া করমু জানি না। ঋণ ক্যামনে শোধ করমু! কামাই রুজিও তো বন্ধ। বন্যার পানি তো নাইমলো, কিন্তু পথে বসাই দিলো।'

বন্যার্ত মানুষের সাহায্যে টাঙ্গাইল থেকে আসা একদল স্বেচ্ছাসেবীর দেওয়া ত্রাণ পেয়ে শরাফত বলেন, 'পানি অন নাই। ত্রাণ আর কয়দিন দিবো। বন্যার পানি তো নাইমছে, কিন্তু জীবন তছনছ করি গেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

16h ago