নোয়াখালীতে বৃষ্টিতে বেড়েছে পানি, নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ
শুক্র ও শনিবার টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালী জেলার আট উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলেও গতকাল জেলায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি পানি রয়েছে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলায়।
এদিকে নতুন করে বাড়িঘরে পানি ওঠায় মানুষজন আবারও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ ও খাবার সরবরাহ না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন বলে জানিয়েছে অনেকে।
নোয়াখালী সদর উপজেলার নেওয়াজপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, গত ১৬ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। ঘর থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাড়িতে উঠি। কিন্তু শুক্র ও শনিবার টানা বৃষ্টির কারণে বসতঘরে হাঁটু পরিমান পানি উঠে। বাধ্য হয়ে শনিবার স্ত্রী সন্তান ও মা বাবাকে নিয়ে স্থানীয় দেবীপুর দারুল আরকান মডেল মাদরাসা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো খাবার বা ত্রাণ নেই। অর্ধাহারে অনাহারে জীবন যাপন করছি আমরা।
একই আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা গোলাপ রহমানের স্ত্রী আলেয়া বেগম (৭০) বলেন জরাজীর্ণ বসত ঘরে কোনোরকম মাথা গোঁজার ঠাই ছিল। কিন্তু গত দুই দিনের বৃষ্টিতে ঘরে পানি উঠার কারণে বাধ্য হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। কিন্তু খাওয়ার কোন ব্যবস্থা না থাকায় খুব কষ্টে রয়েছি।
একই কথা বললেন দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান। তিনি বলেন একটি ডেকোরেশন দোকানে চাকরি করি। কিন্তু বন্যার কারণে গত দেড় মাস ডেকোরেশনের কাজ বন্ধ থাকায় আয় রোজগার নেই। তাই অর্থাভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছি।
অনেকেই নিজের বাড়িতেই রয়েছেন। তবে ত্রাণ না পাওয়ায় কষ্টের কথা জানিয়েছেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার গনিপুর মহল্লার বাসিন্দা রাম দাস (৫৫) বলেন গত আগস্ট মাসের শুরুতে টানা প্রবল বৃষ্টি ও বন্যায় বসতঘরে পানি ওঠে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলায় এক স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। গত সপ্তাহে ঘর থেকে পানি সরে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু শুক্র ও শনিবারের টানা বৃষ্টিতে আবার বাড়িতে পানি ঢুকেছে। কিন্তু এবার কোথাও যাইনি। ত্রাণ ও সহযোগিতা না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। রোববার সারাদিনে ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন স্থল গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বর্ষনের সম্ভবনা রয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বিভাগ এর আওতামুক্ত থাকবে। সোমবার থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাবে।
স্থানীয়রা বলছে, নিচু এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জলাবদ্ধতার পানি নামছে খুবই ধীর গতিতে।
নোয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আঁখিনূর জাহান নীলা বলেন, বন্যার পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু শুক্র ও শনিবারের টানা বর্ষণে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও নোয়াখালী পৌরসভা এলাকায় পানি বেড়েছে। তবে রোববার সারাদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অবপরিবর্তিত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়া লোকজন আবারও শনিবার বিভিন্ন ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদ বলেন, সেনবাগ উপজেলায় বেশি পানি ঢুকেছে। পানি এখনও রয়েছে। এ উপজেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ছাতার পাইয়া, ডুমুড়ুয়া ও কেশারপাড় ইউনিয়নে। এসব ইউনিয়নের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফুর রহমান বলেন, গত শুক্রবার থেকে টানা বৃষ্টির পানিতে উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও চৌমুহনী পৌরসভা এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সোমবার সকাল পর্যন্ত উপজেলায় ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২২ হাজার ৬২৬ জন বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ হাজার ৫০০ লোক ছিল। কিন্তু শুক্র ও শনিবারের প্রবল বর্ষনে কাচা ঘর বাড়িতে পানি ঢোকায় লোকজন পুনরায় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ আহসান উদ্দিন বলেন শুক্র ও শনিবারের প্রবল বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে। পানির চাপে উপজেলার নাহারখিল-খিলপাড়া বাজার সংযোগ ব্রিজটি গতকাল ভেঙে গেছে। এতে করে ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও উপজেলার ৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬৪ পরিবারে ১ হাজার ৬২০ জন আশ্রয় নিয়েছে।
অপরদিকে, হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মিল্টন চাকমা বলেন বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ছোট বড় ২২টি মাছ ধরার ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় জীবিত শতাধিক জেলে ও মাঝিকে এবং ৩টি ট্রলার উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত ১৯টি ট্রলারসহ ৫ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা একজন ও আমতলী ঘাট এলাকার চার জন রয়েছেন। কোস্টগার্ড উদ্ধার অভিযান চলমান রেখেছে।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, রোববার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ৩২৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০ হাজার মানুষ রয়েছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ সর্ম্পকে জেলা প্রশাসক বলেন, রোববার বন্যা কবলিত ৮ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ত্রাণ বাবত চাল ও নগদ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বানভাসি কোন মানুষ যাতে খাদ্যাভাবে কষ্ট না পান সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Comments