বন্যায় ফেনীতে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কত

বন্যায় তলিয়ে গেছে ঘর-বাড়ি। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন ফেনীর প্রবীণ এই দম্পতি। ছবি: স্টার

'ফেনীর দাগনভুঁইয়ার মাতুভূঁইয়া খালে তিনটি লাশ ভেসে উঠেছে। এলাকাবাসীরা লাশগুলো উদ্ধার করেছেন।' সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মরদেহ উদ্ধারের এমন তথ্যে রীতিমতো তোলপাড় পুরো জেলা। স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, 'বন্যার ভয়াবহতা এখন বোঝা যাবে। ফেনী এখন লাশের জনপদ।' 

'দাগনভূঁইয়ায় তিনটি মরদেহের সন্ধান পাওয়া গেছে' এমন খবরের সত্যতা যাচাই করতে যোগাযোগ করা হয় দাগনভূঁইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসিমের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে পুরো দিন আমাদের ওপর ধকল গেছে। থানায় বহু মানুষ ফোন করে বলছে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা গিয়ে অনেকক্ষণ খালে-নদীতে খুঁজে দেখি সেখানে কয়েকটা বস্তা ভাসছে। বস্তার ভেতর খামার থেকে ফেলা মরা মুরগি।' 

তাহলে কীভাবে বিষয়টি নিয়ে এতো তোলপাড় হলো? জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'স্থানীয় দুজন সাংবাদিক না দেখে, অনুসন্ধান না করেই লাশের বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন। পরে ওই দুটি পোস্ট ব্যাপক শেয়ার হয়। এরপরই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।' 

ওসি জানান, দাগনভূঁইয়ায় বন্যায় এখন পর্যন্ত দুজন মারা গেছেন। এরমধ্যে একজন পানিতে ডুবে মারা গেলেও অপরজন মারা গেছেন ত্রাণ নিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায়।

'সোনাগাজীতে মুহুরি নদীতে ভেলায় লাশ ভেসে আসছে, চর চান্দিয়ায় চারটি লাশ পাওয়া গেছে। দুজন নারী ও দুই শিশুর লাশ ভেসে আসছে। মঙ্গলকান্দি ও বগাদানায় তিনটি করে মোট ছয়টি লাশ পাওয়া গেছে। মতিগঞ্জে দুটি লাশ পাওয়া গেছে। ভেলায় করে গতকাল রাতে দুটি লাশ এসেছে। এখন দাফনের অপেক্ষায় আছে।' 

দাগনভুঁইয়ার মতো এমন উড়ো খবরে গত চার-পাঁচদিন ধরে তোলপাড় ফেনীর সোনাগাজীও। এসব ঘটনার সত্যতা জানতে সোনাগাজীর বাসিন্দারা থানায় একেরপর এক কল করছেন। 

ছবি: স্টার

বিষয়টি জানার জন্য সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুদীপ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য ডেইলি স্টার।

ওসি বলেন, 'পুরো বিষয়টিই গুজব। বন্যায় এখন পর্যন্ত আমরা মোট পাঁচটি লাশ পেয়েছি। এই লাশগুলো আমরা পেয়েছি ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ আগস্টে।'

শুধু দাগনভূঁইয়া কিংবা সোনাগাজীই নয়। 'নদী ও খাল থেকে লাশ ভেসে উঠছে, ভেলায় লাশ ভেসে আসছে, লাশে পচন ধরেছে, দু-তিনটি লাশের খবর পাওয়া গেছে' এমন তথ্য ছড়াচ্ছে ফেনীর সর্বত্র।

এ বিষয়ে ফেনী মডেল থানার ওসি রুহুল আমীন বলেন, 'আমরাও গত কয়েকদিন ধরে শুধু লাশের খবর পেয়েছি। গিয়ে দেখি কিছুই না। আমাকে এক ব্যক্তি ফোন করে বললেন, কাঠের সঙ্গে লাশ বেঁধে আছে। গিয়ে দেখি সাধারণ একটি বস্তা পড়ে আছে। আজকেও আমাকে দুজন ব্যক্তি ফোন করে বলেছেন, তারা একটি লাশ দেখতে পেয়েছেন। আমি ফোর্স পাঠিয়ে দেখি সেখানে কিছুই নেই।'

বন্যায় এখন পর্যন্ত ফেনী সদরে তিনজন মারা গেছেন বলে জানান তিনি।

গতকাল রাতে ফেনীর ছয়টি থানার ওসির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকর। তারা প্রত্যেকেই জানান, এসব উড়ো খবরের বিষয়ে জানতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও বিদেশ থেকে প্রবাসীরা থানাগুলোতে একেরপর এক ফোন কল আসছে। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো বিব্রত ও বিরক্ত তারা। 

মূলত ফেসবুক থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ায় এমনটি হয়েছে বলে জানান থানা সংশ্লিষ্টরা।  

বন্যায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কত

বন্যায় ফেনীতে মোট কতজন মারা গেছেন? জানতে চাইলে ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, 'গতকাল পর্যন্ত বন্যায় ফেনীতে ১৯ জন মারা গেছেন। তবে তাদের মধ্যে কতজন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন, নাকি অন্য কোনো কারণে মারা গেছেন, তা আলাদাভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।'

তবে মরদেহ নিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় গুজব ছড়ানোর সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'জেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করছে। সংবাদমাধ্যমের জন্য মিডিয়া সেলও খোলা হয়েছে। যে কেউ চাইলে আমাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্যটি পাচ্ছেন।'

জেলা প্রশাসন সূত্র বনাম থানা সূত্র

জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ফেনীতে ১৯ জন মারা গেছেন। এই প্রতিবেদক জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতেও খোঁজ নেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যায় ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় পাঁচজন, দাগনভূঁইয়া উপজেলায় দুজন, ফেনী সদরে তিনজন, পরশুরাম উপজেলায় দুজন, ফুলগাজী উপজেলায় সাতজন এবং ছাগলনাইয়া উপজেলায় তিনজন মারা যান।

থানা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এখন পর্যন্ত ২২ জনের মরদেহ পাওয়া গেলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।

তবে এই প্রতিবেদকের যাচাইয়ে বাড়তি একজনের তথ্য পাওয়া যায়। 

পরশুরাম থানা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের ধনিকুণ্ডা গ্রামের বাসিন্দা সাহাব উদ্দিনের মরদেহ পাওয়া যায় ফুলগাজীর ঘনিয়া মোড়া গ্রামে। পানিবন্দি মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে যাওয়ার পথে পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি। ছয়দিন পর মঙ্গলবার দুপুরে ঘনিয়ামোড়া গ্রাম থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পরশুরামের ধনিকুন্ডা গ্রামে দাফন করা হয়। মূলত এ কারণেই ফুলগাজী থানায় একজনের মৃত্যু বেশি দেখানো হয়েছে। 

ফেনীর ছয়টি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে বন্যায় মৃত ব্যক্তির সংখ্যার একটি চিত্র পাওয়া যায়। 

ফেনী সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ফেনী সদর থানায় এখন পর্যন্ত তিনজন মারা গেছেন। এরমধ্যে দুজনের মরদেহ পাওয়া যায় ফেনীর লালপোলে। অপর মরদেহটি পাওয়া যায় ফেনীর সোনাগাজী সড়কের ধলিয়া ইউনিয়নে।

দাগনভূঁইয়া থানা সূত্রে জানা যায়, বন্যায় দাগনভূঁইয়া উপজেলায় এখন পর্যন্ত দুজন মারা যান। এদের মধ্যে একজন পানিতে ডুবে মারা গেলেও অন্যজন ত্রাণ নিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। নিহতদের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেছে উপজেলার উত্তর করিমপুর গ্রামের নুর নবীর ছেলে  আট মাস বয়সী নুর মোহাম্মদ। ত্রাণ নিতে গিয়ে ২৮ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে জয়লস্কর ইউনিয়নের উত্তর আলমপুর গ্রামের হুমায়ুন কবিরের ছেলে জাফরুল ইসলাম।

ছবি: স্টার

সোনাগাজী থানা সূত্রে পাওয়া তথ্যে উপজেলায় পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ ও এলাকাবাসী। এদের মধ্যে দুজনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে।

থানা সূত্রে জানা যায়, ২৬ আগস্ট সোনাগাজী ইউনিয়নের মুহুরি নদীর বাঁধের পাশ থেকে মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের নাঈম উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। ২৭ আগস্ট রাতে সোনাগাজী ইউনিয়নের মুহুরি নদীর পাড়ে ছাড়াইতকান্দি গ্রামের মাবুল হকের ছেলে তিন বছর বয়সী আবিরের মরদেহ পাওয়া যায়। ২৮ আগস্ট আমিরাবাদ ইউনিয়নের মুহুরি নদীর পাড়ে কলার ভেলায় ভেসে আসা অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের মরদেহ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল ২৯ আগস্ট মুহুরি নদীর প্রজেক্টের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে চর চান্দিয়া ও চর দরবেশ ইউনিয়নের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় অজ্ঞাতনামা আরেকটি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় সোনাগাজীর চর আবদুল্লাহ এলাকা থেকে  স্থানীয় মানুষের সহায়তায় একজনের মরদেহ উদ্ধার করে সোনাগাজী থানার পুলিশ।

ফুলগাজী থানা সূত্রে মৃত সবার পরিচয়ই পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা শাকিলা আক্তার , উত্তর করইয়া গ্রামের কিরণ, দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের রাজু, কিসমত বাসুড়া গ্রামের আবুল খায়ের, লক্ষ্মীপুর গ্রামের সৈয়দ তারেক ও শনিরহাট গ্রামের  রজবের নেছা।

ছাগলনাইয়া থানা সূত্রে জানা যায়, বন্যায় মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে শুভপুর ইউনিয়নের উত্তর মন্দিয়া গ্রামের ফুরফুরের নেসা নামে আরেক নারীর মরদেহ তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। বন্যার কারণে তিনি বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি বলে থানা সূত্রে জানা যায়।

থানা সূত্রে আরও জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের মিজাজী খালে ভাসমান অবস্থায় আইয়ুব খান নামে ৬০ বছর বয়সী স্থানীয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে গ্রামবাসী।

উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পূর্ব শিলুয়া গ্রামে ভেলায় ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাতনামা এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

পরশুরাম থানা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার উত্তর ধনীকুন্ডা এলাকার সাহাব উদ্দিন ও মির্জানগর ইউনিয়নের মধুগ্রামের দেলোয়ার হোসেন বন্যায় মারা গেছেন।

হিসাবের বাইরেও আরও মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে  

বন্যায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরও পাঁচজনের সম্পর্কে জানতে পেরেছেন এই প্রতিবেদক। এদের মধ্যে গত ২৪ আগস্ট ফেনী শহরের মিজান রোডে ভেলায় ভাসমান অবস্থায় এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় মানুষ। পরবর্তীতে শিশুটিকে অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হয়।

এ ছাড়া, ২৩ আগস্ট ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের সাতসতী গ্রামের বাসিন্দা আলীমউল্লাহর মৃত্যুর পর ভেলায় করে তার মরদেহ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন স্বজনরা। 

এই দুজনের তথ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না? জানতে চাইলে ফেনী সদর থানার ওসি বলেন, 'এই দুজনের বিষয়ে আমাদের এখনো জানা নেই। তাই মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।'

মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার আজ সকালে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল পর্যন্ত আমরা যে সংখ্যা পেয়েছি তার বাইরেও বন্যায় মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Govt Logo

All 64 DCs protest suggested change to promotion criteria for deputy secy post

The Bangladesh Administrative Service Association (Basa) has also issued a statement protesting the proposal

43m ago