যে দেশে ঋণখেলাপিরা পুরস্কৃত হন!

অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

বিশ্বজুড়ে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেক দেশ তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়। আইনি ব্যবস্থা নেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে ঋণখেলাপিরা বড় ধরনের ছাড় পান।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় একটি ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা দিয়েছে। এখানে ঋণখেলাপিদের জন্য ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মাত্র ১০ শতাংশ পরিশোধের বিনিময়ে সুদ মওকুফের সুযোগ দেওয়া হবে।

নীতিমালা অনুসারে, খেলাপিরা তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছর সময় পাবেন।

জাতীয় সংসদে যখন সুদ মওকুফের বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তখন এই উদ্যোগ 'চোখে ধুলো' দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় বলেই মনে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া পরামর্শ অনুসারে, ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকের জন্য পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কিছু নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে গ্রাহকদের আর্থিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এজন্য ঋণ আদায়ে 'এক্সিট পলিসি' নামে এই বিশেষ সুবিধা চালু করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এমন নীতির অপব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ আছে। বিশেষ করে, যখন এমন সুযোগ বছরের পর বছর ধরে দেওয়া হবে।

২০১৯ সালে ব্যবসায়ীদের চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'ওয়ান টাইম এক্সিট পলিসি' চালু করেছিল। এতে খেলাপিরা তাদের মোট ঋণের বিপরীতে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সুদ মওকুফের সুযোগ পেয়েছিলেন।

এই নীতিমালার আওতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এই নীতিমালার অধীনে, ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলো পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে। এটি আগের বছরের এক হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার তুলনায় ১৭৩ শতাংশ বেশি।

সুদ মওকুফের পাশাপাশি খেলাপিদের বারবার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগও দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মাত্র দুই শতাংশ পরিশোধের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওই বছর এই নীতিমালার অধীনে, রেকর্ড ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনকার মতো একই কারণ দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে শিথিল নিয়ম চালু করেছে।

তবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এমন উদার প্রস্তাব হিতে বিপরীত হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন এক্সিট পলিসি চালু করে, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা।

এ ছাড়াও—পুনঃতফসিল করা ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণ ও মামলা-মোকদ্দমাসহ ঝুঁকিতে থাকা ঋণের পরিমাণ এখন চার লাখ কোটি টাকারও বেশি।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এ ধরনের শিথিল নীতি বারবার নেওয়া হলে তা খেলাপিদের ঋণ পরিশোধ না করতে অনুপ্রাণিত করে। তাদের মতে, খেলাপিরা সবসময় বড় ছাড় পান।

খেলাপিদের জন্য এ ধরনের 'পুরস্কার'র কারণে নিয়মিত ঋণগ্রহীতারাও খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়াসহ অধিকাংশ দেশই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। বিশেষ করে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হন।

যেমন, মালয়েশিয়ায় খেলাপিদের দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। চীন তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কাজের সুযোগ কমিয়ে দেয়।

কোনো কোনো দেশে ঋণখেলাপির সন্তানরা ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। কিন্তু, বাংলাদেশে ঋণখেলাপি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করে।

এর চেয়েও বড় কথা—খেলাপিরা সব সময় ঋণ পরিশোধে ছাড় পান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেন।

যদিও খেলাপির লাগাম টানতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে।

সংশোধিত বিধিমালায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার পর পরবর্তী পাঁচ বছর ব্যাংক পরিচালক হতে পারবেন না। তাদেরকে জাতীয় পুরষ্কারের জন্যও অযোগ্য করা হয়েছে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাওয়ার অযোগ্য হবে।

তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ওপর এমন কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা কঠিন হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

Comments

The Daily Star  | English

BNP sticks to demand for polls by December

In a meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night, the BNP restated its demands that the next general election be held by December and the government immediately announce a roadmap to that end.

3h ago