বড় খেলাপিদের ঋণ আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে নেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ আদায় করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের ব্যর্থতার কারণে আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। পাশাপাশি নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমে গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকগুলোকে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী ঋণ আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু, ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ আদায়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এই মন্দ ঋণ নিয়ে চাপে আছে সরকার। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির একটি নির্দেশনা হলো- ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হিসাব করা হলে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সোনালী ব্যাংককে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা আদায় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকটি এর মাত্র ১২ শতাংশ আদায় করতে পেরেছিল। অবশ্য তা ২০২২ সালে আদায় করা ৪ শতাংশের তুলনায় বেশি ছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
ডিসেম্বরে সোনালী ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির হাতে ছিল চার হাজার কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আছে- টিঅ্যান্ড ব্রাদার্স, হলমার্ক গ্রুপ, মডার্ন স্টিল মিলস, ফেয়ারট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস ও সোনালী জুট মিলস।
এর মধ্যে হলমার্কের ঋণ ব্যাংকটির জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল।
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হলমার্ক গ্রুপসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বড় অঙ্কের এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল জাল নথির ভিত্তিতে। পরে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে ঋণগ্রহীতারা পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তারা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, হলমার্কের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারের আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে।
হলমার্ক গ্রুপের বেশ কিছু সম্পত্তি এ বছর সোনালী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।'
এছাড়া গত বছর শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৮৭০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল জনতা ব্যাংককে। কিন্তু ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র পাঁচ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে। যদিও ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের ঋণ আদায় হয়েছিল ১১ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল- অ্যাননটেক্স গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রানকা গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার, চৌধুরী গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপ।
তবে হাইকোর্টে রিট করার পর ঋণ বিবরণীতে থার্মেক্স ও সিকদার গ্রুপের ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখানো হয়।
জনতা ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ আছে অ্যাননটেক্সের ৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক অবস্থার জন্য মূলত অ্যাননটেক্স গ্রুপ দায়ী।
এর মধ্যে ২০২২ সালে এককালীন ঋণ পরিশোধের শর্তে অ্যাননটেক্সের ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জনতা ব্যাংক। কিন্তু পরে সেই সুদ মওকুফের সুবিধা বাতিল করে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, জামানত বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেতে যাচ্ছে অ্যাননটেক্স।
ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ছিল জনতা ব্যাংকের ২৫ হাজার ৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায়।
জনতার খেলাপি ঋণ ব্যাংকটিকে বড় ঋণ দেওয়া বন্ধ ও শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করে।
সম্প্রতি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
অন্যদিকে ২০২৩ সালের জন্য নির্ধারিত ৬৮৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩ শতাংশ পেরেছে অগ্রণী ব্যাংক। ঋণ আদায়ের এই ঘাটতির কারণে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২২ সালের ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকটির শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে- জাকিয়া গ্রুপ, জাজ ভূঁইয়া গ্রুপ, তানাকা গ্রুপ ও ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন লিমিটেড।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ে তারা আলাদা টিম গঠন করতে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে ঋণ আদায়ের রূপালী ব্যাংকের অগ্রগতি অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো।
গত বছর রূপালী ব্যাংককে বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে।
গত বছরের জুন পর্যন্ত রূপালীর শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে ছিল- নূরজাহান গ্রুপ, বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এ নেট স্পিন লিমিটেড, ভার্গো মিডিয়া (চ্যানেল নাইন), এইচআর স্পিনিং মিলস, ইব্রাহিম কনসোর্টিয়াম, এসএ গ্রুপ ও এম রহমান স্টিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
গতকাল রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ব্যাংকটি শীর্ষ খেলাপিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে এবং খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর করতে ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের প্রচেষ্টায় গত বছর ভালো ফল পেয়েছি। আমরা এই মোমেন্টাম ধরে রাখব।'
Comments