পারকিনসনস রোগ কেন হয়, প্রতিরোধে করণীয় কী

প্রতীকী ছবি

পারকিনসনস রোগ কী, অনেকেই হয়ত জানেন না। অথচ দেশে গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পারকিনসনস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। 

রোগটি কী, কেন হয়, লক্ষণ কী এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী।

পারকিনসনস রোগ কী

ডা. জহিরুল হক জানান, পারকিনসনস হলো স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, এজিং প্রসেসের কারণে এটি হয় অর্থাৎ, বয়স বাড়তে থাকলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, 'জন্মের পর প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদের হাত-পা বড় হয়, চোখ বড় হয়, মস্তিষ্কসহ সবকিছুই বড় হয়। একইভাবে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের পর থেকে এগুলো ক্ষয় হতে শুরু করে। বয়স হলে চুল পাকে, চোখে কম দেখে, চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, একইসঙ্গে মস্তিষ্কেরও ক্ষয় হতে থাকে।'

'মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগের নামই পারকিনসনস, যখন মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার কমতে শুরু করলে বা ঘাটতি দেখা দিলে পারকিনসনস রোগ দেখা দেয়। যখন বয়স বাড়ে তখন ধীরে ধীরে ডোপামিন লেভেল কমে যায়। বাইরে থেকে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয় রোগীকে। একটা সময় দেখা যায় রোগীর অবস্থা এত খারাপের দিকে যায় যে ডোপামিন সাপ্লিমেন্ট দিয়েও বেশি লাভ হয় না।'

ডা. জহিরুল বলেন, 'এই রোগের লক্ষণ শুরুর দিকে খুব একটা বোঝা যায় না। খুব ধীরে এর লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই শুরুর দিকে এক হাতে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি দেখা যায়। পরবর্তীতে হাঁটাচলা, কথা বলা, ঘুমানোর ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে শুরু করে। গড় আয়ু বাড়ার কারণে আমাদের দেশে পারকিনসনস রোগ বাড়ছে।'

পারকিনসনস রোগের কারণ

ডা. জহিরুল হক বলেন, 'পারকিনসনস রোগের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে জিনগত সমস্যা থেকে পারকিনসনস রোগ হতে পারে। জেনেটিক মিউটেশন হয়ে তরুণদের এই রোগ হতে পারে। বয়স্কদেরও জেনেটিক কারণে হতে পারে, তবে তা কম। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনদের কারও থাকলে পারকিনসনস হতে পারে।'

এছাড়া, দূষিত পরিবেশে থাকলে, বিষাক্ত ও রাসায়নিক কারখানায় কাজ করলে পারকিনসনস রোগ হতে পারে।

তিনি জানান, মস্তিষ্কের ভেতর ঝোঁপের মতো কিছু জড়বস্তুর উপস্থিতি পারকিনসনস রোগের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত। এগুলো 'লুই বডি' নামে পরিচিত। অনেক সময় মস্তিষ্কে 'লুই বডি' বেশি জমা হলে পারকিনসনস রোগ হতে পারে।

নারীদের তুলনায় পুরুষদের পারকিনসনস রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি বলে জানান তিনি।

পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ

এ রোগের লক্ষণ সবার জন্য একরকম হয় না বলে জানান ডা. জহিরুল হক। শুরুর দিকে লক্ষণ বোঝা নাও যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণ শরীরের একপাশে শুরু হয়। পরবর্তীতে শরীরের উভয় পাশই আক্রান্ত হতে পারে।  সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর থেকে পারকিনসনস রোগের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। 

লক্ষণগুলো হলো:

১. প্রথমে হাত-পা কাঁপা শুরু হয়, প্রথমে এক পাশের হাত কাঁপে, পা কাঁপে। পরে শরীরের দুই পাশেই হাত-পা কাঁপে।

২. হাত ও পায়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা অনুভব হয়, যে কারণে চলাচল করতে সমস্যা হয়।

৩. হাত-পায়ের সঞ্চালন কমে যায়, নড়াচড়া কমে যায় বা ধীরগতি হয়ে হয়।

৪. ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, চলাফেরার সময় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৫. স্মরণশক্তি কমে যায়, ঘুম কম হয়।

৬. হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ানোর সময় রক্তচাপ কমে যাওয়ার ফলে মাথা ঘোরা বা মাথা ঝিমঝিম করতে পারে, যাকে অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন বলে।

এছাড়া আরও কিছু লক্ষণ দেখা যায় পারকিনসনস রোগীর। এগুলো হলো:

১. ভাবলেশহীন মুখ

২. অনেক সময় মুখ দিয়ে লালা ঝরা

৩. ওঠা, বসা, হাঁটা-চলা দেরিতে শুরু হয়

৪. হাঁটতে গেলে ছোট ছোট পা ফেলা

৫. ঘুরতে অসুবিধা হয়, ডান দিকে কিংবা বাম দিকে ঘোরার সময় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা

৬. মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, উদ্বেগ, হতাশা, দুঃশ্চিন্তা বেশি হয়, হ্যালুসিনেশন হয়

৭. কোষ্ঠকাঠিন্য হয়

৮. রোগীর কথা জড়িয়ে আসে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত কথা বলেন, লিখতে গেলে লিখতে পারেন না

৯. দৈনন্দিন কাজগুলো সাধারণত যেভাবে করতেন, সেভাবে করতে পারছেন না

চিকিৎসা

ডা. জহিরুল হক বলেন, 'পারকিনসনস রোগ চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা ও শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করতে হয়। 

প্রয়োজন হলে চিকিৎসক ডোপামিন ট্রান্সপোর্টার টেস্ট করতে বলতে পারেন। এছাড়া এমআরআই, সিটি স্ক্যানের পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী রোগীকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। ক্ষেত্রবিশেষে মস্তিষ্কে আক্রান্ত অংশে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

প্রতিরোধের উপায়

পারকিনসনস রোগ প্রতিরোধে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, যেমন—আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে, ফল, শাকসবজি খেতে হবে।  এছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার পারকিনসনস রোগ প্রতিরোধে উপকারী।

নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, সাঁতার কাটতে হবে। সকালে আধাঘণ্টা ও রাতে আধাঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। বাগান করা, হালকা ব্যায়াম করা রোগীর জন্য উপকারী।

আর যদি পারকিনসন্স রোগ হয়েই যায় তাহলে আক্রান্তের কিছু সর্তকতা মেনে চলা জরুরি। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, ধীরে ধীরে হাঁটতে হবে, যেন মাথা ঘুরে পড়ে না যায়, ভারসাম্যহীনহীনতা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সহযোগী রাখতে হবে রোগীর পাশে।

পারকিনসনস রোগ পুরোপুরি ভালো হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধ এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলে জানিয়েছেন ডা. জহিরুল হক।


 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago