জাপানিদের বেশি দিন বাঁচার নেপথ্যে

ছবি: সংগৃহীত

নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের অবিনশ্বর হতে চাওয়ার বাসনা ভীষণ আদিম। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ দুনিয়ার মোহে পড়ে অমরত্ব লাভ করতে চেয়েছে বারবার। অমরত্বের অমৃত সুধা পান করবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কেবল রূপকথায় নয়, বাস্তবেও প্রচলিত ছিল।

ঋগ্বেদের ভাষ্যমতে, 'অমৃত' এমন একটি পানীয় যা খেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে সক্ষম। সনাতন ধর্মসহ অন্যান্য সংস্কৃতিতে এটি 'সোমা' নামে উল্লেখিত। স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র এবং অনলের দেবতা অগ্নিও অমৃত পান করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে।

বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসন নিজের ক্লোন তৈরি করে অমর হতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল এ ক্লোন থেকে একটি ক্ষুদে জ্যাকসন দলের সৃষ্টি হবে। এছাড়া কমপক্ষে ১৫০ বছর বেঁচে থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন অক্সিজেন চেম্বার, সেখানেই ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু হায়! জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা হবে? অর্থাৎ জন্ম নিলে মৃত্যু অনিবার্য। মানুষ মরণশীল কিন্তু দেশে দেশে মৃত্যুর বয়সে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোনো দেশের মানুষের গড় আয়ু ৫৪ আবার কোথাও ৮৫।

ওয়ার্ল্ড পপিউলেশন রিভিউ ও ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য মতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু হংকংয়ের ৮৫ দশমিক ২৯ বছর। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানের গড় আয় ৮৫ দশমিক শূন্য ৩ বছর। সর্বনিম্ন ৫৪ দশমিক ৩৬ বছর গড় আয়ুর দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, জাপানের লোকেরা ৭৫ বছর পর্যন্ত কোন ধরনের দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই বাঁচতে পারে। জাপানের নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। পুরুষদের গড় আয়ু ৮১ দশমিক ৯১ বছর এবং নারীদের গড় আয়ু ৮৮ দশমিক শূন্য ৯ বছর।

কিন্তু জাপানিদের দীর্ঘ জীবনলাভের রহস্যটা কী? তারা কী তবে স্বর্গের অমৃতসুধা পান করতে পেরেছে নাকি নিজেদের ক্লোনিং করতে পারছে? চলুন দেখে আসি-

খাদ্যাভ্যাস

বিজ্ঞানীরা জাপানিদের এই দীর্ঘায়ুর কারণ হিসেবে তাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কথা বলছেন। অনেক জাপানি আছেন যারা সারাজীবন কাটিয়ে দেন কেবল সুশি ও শাকসবজি খেয়ে যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা একেবারেই অসম্ভব। এছাড়া আধুনিক জাপানিদের খাদ্যতালিকায় উচ্চমানের পুষ্টি ও কম ক্যালরিযুক্ত খাবার তাদের সুস্বাস্থ্যের অন্যতম কারণ। মাছ আর শাকসবজি দিয়ে তৈরি অসাধারণ খাবারগুলো তাদের জীবনের দৈর্ঘ্য অনেক বাড়িয়ে দেয়। আর এ খাবারগুলোর বেশিরভাগই সামান্য দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয়।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, জাপানিদের প্রচলিত এই ডায়েটের ফলে পশ্চিমাদেশের তুলনায় জাপানিরা ২৫ ভাগ কম ক্যালরি খাবার গ্রহণ করে। শুধু এই কারণেই অন্য দেশের তুলনায় জাপানিরা ৮ ভাগ গড় আয়ু বেশি পেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এ কারণে তাদের লিভারের কার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কম পড়ে।

জাপানিদের কিছু সাধারণ খাবার এবং পানীয়

মাছ

পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীর মানুষ যেখানে মাংস খেতে ব্যাকুল সেখানে জাপানিরা মাংসের চেয়ে মাছ খেতে বেশি ভালবাসে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ ভাগ জাপানি হলেও তারা পৃথিবীর মোট মাছের ১০ ভাগ খেয়ে থাকে।

সামুদ্রিক শৈবাল

জাপান হচ্ছে একটি দ্বীপদেশ যার চারপাশ মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই এখানকার মানুষ সবসময় প্রচুর সীফুড খাওয়ার সুবিধা পায়। কিছু খাদ্যবিদদের মতে, জাপানি খাদ্য নির্ভর করে প্রধানত শস্যের উপর। সঙ্গে থাকে শাকসবজি কিংবা সামুদ্রিক শৈবাল।

সামুদ্রিক শৈবাল বা সমুদ্রের বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ জাপানীদের প্রিয় খাবার। তারা সাধারণত সামুদ্রিক শৈবাল স্যুপ বা সালাদ হিসেবে খায়। ধারণা করা হয় বছরে ১ লাখ টন সামুদ্রিক শৈবাল শুধু জাপানীরাই খায়।

সুশি

সুশি জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার যা সময়ের সঙ্গে জাপানের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বের রসনায় সগৌরবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। এটি এতটাই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে যে প্রতিবছর ১৮ জুন পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সুশি দিবস। রাজধানী ঢাকাতেই জাপানি খাবার সুশিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক রেস্তোরাঁ। সুশিতে থাকে ভাত, মাছ আর সবজি। বিভিন্ন ধরনের সুশির মধ্যে সামুদ্রিক কাঁচা মাছ, আঠালো ভাত আর সয়াসসের মিশ্রণে যে সুশিটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এর নাম 'ওশি-জুশি'। সুশি খেতে যেমন সুস্বাদু, খাদ্যমানও বেশ ভালো। ভিটামিন, প্রোটিন আর ক্যালরির চমৎকার মেলবন্ধন কয়টা খাবারে আর মেলে বলুন?

চা

জাপানিদের অতি সাধারণ এক পানীয় চা। জাপানের বেশির ভাগ মানুষ 'গ্রিন টি' বেশ আগ্রহ নিয়ে পান করে। গ্রিন টি স্বাদে সাধারণ চা হতে আলাদা হলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।

সবজি

জাপানিদের প্রতি বেলার খাবারে অন্তত ৪টি সবজি অতি সাধারণ ব্যাপার। বিভিন্ন স্যুপ বা সালাদ আকারে জাপানিরা সবজি খায় ভাতের চেয়েও বেশি। শাকসবজির পুষ্টিগুণ এবং তারুণ্য ধরে রাখার ক্ষমতা আশা করি কারোই অজানা নয়।

ভেষজ গাছ রোপণ

জাপানের ওকিনাওয়া অঞ্চলের বাড়িগুলোতে আদা, হলুদ, রসুনসহ বিভিন্ন ভেষজের গাছ থাকে। এ সব গাছের বিভিন্ন উপাদান শরীরের বিভিন্ন রোগ সারাতে দারুণ কার্যকর। তাই জাপানিরা রোগে, অসুস্থতায় বাজারের কেনা ওষুধের চেয়ে প্রাকৃতিক ভেষজ গাছের উপরই বেশি নির্ভর করে থাকে।

লাইফস্টাইল

শুধু খাবার-দাবার নয়, জাপানিরা জীবনযাত্রার ব্যাপারেও অত্যন্ত সচেতন। জাপানের জনগণ জাতি হিসেবে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও পরিশ্রমী জাতি। পরিশ্রম তাদের রোগবালাই কম হয়। বলা ভালো পরিশ্রম করার কারণে জাপানিদের বার্ধক্য দেরিতে আসে। সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে তারা নিয়মিত ব্যায়াম করে থাকে। জাপানিরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে এবং তাদের এই গুন সারাবিশ্বে খুবই সমাদৃত।

জাপানের মানুষ হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে যা তাদের হার্টকে নিরাপদ রাখার অন্যতম কৌশল।

জাপানি সংস্কৃতি

জাপানের সংস্কৃতিতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যার ফলে জাপানের মানুষদের বয়স বাড়তে থাকলেও যাবতীয় মানসিক চাপের মুখোমুখি পড়তে হয় না।

Comments

The Daily Star  | English

US cuts tariffs on Bangladesh to 20% after talks

The deal for Dhaka was secured just hours before a midnight deadline set by President Donald Trump

1h ago