২১ মাসের মধ্যে বেসরকারি খাতে সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি

বাংলাদেশ ব্যাংক, ঋণ, প্রবৃদ্ধি, ব্যাংক, বেসরকারি খাত, ঋণপত্র, এলসি,
ফাইল ফটো

চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ দেশে ও বিদেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা এক মাস আগে ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। যা ২০২১ সালের অক্টোবরের পর সর্বনিম্ন, ওই বছরের অক্টোবের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, আমানতের ধীর গতি এবং ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে।

জুলাইয়ের এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ০৮ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ।

কিন্তু, ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া একদিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। কারণ এটি দেশে চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও মার্কিন ডলারের চাহিদা কমাতে সহায়ক হতে পারে। গত এক বছরে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দর বেড়েছে। ফলে, আমদানি খরচও বেড়েছে।

কিন্তু, দিন শেষে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো নাও হতে পারে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।'

এই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির একটি বড় অংশ আসে আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র থেকে। তবে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হওয়ায় ঋণপত্র খোলার পরিমাণ অনেক কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৩৭ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অর্থবছরের একই মাসের ৬.৩৫ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩১.১৯ শতাংশ কম। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে ১৭৯ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। শিল্পখাতে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা ৩৬ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নিম্নমুখী এই প্রবণতা শিল্প খাতের স্থবিরতার ইঙ্গিত।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে শিল্প উৎপাদন কমবে। ফলে, অনাদায়ী ঋণ ও ফোর্স লোন বৃদ্ধি পাবে।'

যখন গ্রাহক মেয়াদপূর্তিতে তাদের ঋণপত্র পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তখন ফোর্স লোন তৈরি হয়।

এছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাত তারল্য ঘাটতির সম্মুখীন হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও চাপের মুখে পড়েছে। এর মূল কারণ, আমানত বৃদ্ধির ধীরগতি ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ হতে পারে।

মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, 'আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা চাহিদার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর উদ্যোগের কারণে অটোমোবাইলসহ বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি দ্রুত কমেছে। দেশের রিজার্ভ ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে।

ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য এই ব্যাংকার ঋণ আদায়ের ধীর গতিকেও দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রাহকরা মূলত অপেক্ষা করছেন, তারা দেখতে চাচ্ছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। এছাড়া, চলমান মার্কিন ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে সমস্যায় পড়ছেন। বেশ কয়েকটি সম্প্রসারিত প্রকল্পও পিছিয়েও গেছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

তিনি আরও বলেন, 'বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার কারণে রপ্তানি আদেশও কমেছে।'

ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যা আমদানি ও উত্পাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণেও খুব রক্ষণশীল নীতি মেনে চলছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো সূচক নয়।

তিনি সতর্ক করেন, অর্থনীতি ও ব্যবসা খাত স্থবির হয়ে পড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago