বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতের দুর্দশার চিত্র

বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকিংখাত, ব্যাংক, আইএমএফ,
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

প্রথমবারের মতো ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে ব্যাংকিং খাতের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।

বর্তমানে ব্যাংকিং খাত নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা আছে, কারণ, অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয়ে থাকে এই খাত।

অতীতে, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের সম্পদের আংশিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করত। তবে, সর্বশেষ তথ্যটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দেওয়া ঋণের শর্তের সঙ্গে জড়িত।

রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি রিপোর্টে অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকায়।

খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন ঋণ বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হিসাব করা হয়।

২০২২ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা, পুনঃতফসিল ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা এবং অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।

২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তার ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি রিপোর্টে বিভিন্ন আকারে ও আংশিকভাবে পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন ঋণের তথ্য প্রকাশ করে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এবার বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন করা ঋণের মোট চিত্র তুলে ধরেছে।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক ব্যাংকিং খাতে ঋণ পুনঃতফসিল একটি স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস, কিন্তু পুনঃতফসিল করা সব ঋণ খেলাপি নয়। এ ধরনের ঋণের ২ থেকে ৩ শতাংশ খেলাপি হয়, তাই বিষয়টি উদ্বেগজনক নয়।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ব্যাংকাররা। তারা বলেন, পুনঃতফসিল করা ঋণ ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো নয়, বরং এগুলো ব্যাংকের জন্য বোঝা।

অবশ্য ব্যাংকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কারণ, এতে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা উঠে এসেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, 'এনপিএল, পুনঃতফসিল ঋণ, বা অবলোপন ঋণ যেভাবেই ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থাকুক না কেন, তা ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো নয়।'

তিনি বলেন, 'এ ধরনের সম্পদ ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ায় ও মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত এবং প্রভিশনিংয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়ে, তখন তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়।'

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, যেহেতু আইএমএফের কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা উঠে এসেছে, তাই এই খাত এখন সঠিক পথে আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ব্যাংকগুলো রেকর্ড ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুধু পুনঃতফসিল ও অবলোপন ঋণই নয়, ব্যাংকিং খাতের প্রায় সব সূচকই এই খাতের সংকটকে তুলে ধরেছে।

অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষে এনপিএলের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা, কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রকৃত তথ্য না দেওয়ায় প্রকৃত পরিমাণ আরও বেশি হবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার পুনঃতফসিল ঋণ এই খাতের জন্য উদ্বেগের বিষয়।

তিনি বলেন, 'ঋণ অনুমোদনের সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে পুনঃতফসিল করা কিছু ঋণ আর ব্যাংকে ফেরত আসে না। ঋণ আদায়ের গতি বাড়াতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতের উন্নতি হবে না।'

তিনি ব্যাংকগুলোকে আইনি প্রক্রিয়া ব্যবহার করে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার আহ্বান জানান।

তবে আনিস এ খান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির কারণে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্য বেশিরভাগই সঠিক। কিন্তু, দেশের স্বার্থে কিছু মন্দ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। কারণ, এনপিএলের অনুপাত বাড়লে বিদেশি ব্যাংকগুলো স্থানীয় ব্যাংককে সেবা দেওয়ার সময় বেশি চার্জ নেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সিটি ব্যাংক এনএ বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি চিফ মামুন রশীদ ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, 'ভালো ঋণগ্রহীতা ও মন্দ ঋণগ্রহীতাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা খেলাপি মামলা ও পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ ঋণ দেওয়া।'

Comments

The Daily Star  | English

Will protect investments of new entrepreneurs: Yunus

Yunus held a meeting with young entrepreneurs at the state guest house Jamuna where15 male and female entrepreneurs participated

4h ago