ব্যাংকের মুনাফায় বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের প্রভাব
চলতি বছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের ৩৫টি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সর্বমোট মুনাফা ৯ শতাংশ কমে ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চলমান অস্থিতিশীলতা রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার থেকে ব্যাংকগুলোর কমিশন আয় কমেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ ভালো মুনাফা করলেও ১৩টির আয় কমেছে। কিন্তু, মুনাফা করা ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধির গতি তুলনামূলক কম ছিল। ফলে, লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলো মুনাফা করা ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত লাভকে ছাড়িয়ে গেছে।
যেমন- ব্যাংক এশিয়ার মুনাফা ৬ মাসে ৫২ শতাংশ বেড়ে ৩৫৪ কোটি টাকা হয়েছে এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান প্রায় ২৬২ শতাংশ কমে ৬২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী ইমাম বলেন, 'কমিশন ও ব্রোকারেজ ফি থেকে আয় কম হওয়ায় এ বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমেছে।'
কোম্পানিটি প্রায় ১৪০ কোটি টাকার সম্পদ পরিচালনা করে, যার বেশিরভাগ ব্যাংকিং স্ক্রিপসহ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়।
আলী ইমাম জানান, ডলার ঘাটতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলার ক্রয় ও বিক্রয় দর ঠিক করে দেওয়ায় তাদের কমিশন আয় কমেছে।
২০২২ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সব ব্যাংককে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ১ টাকা মার্জিন বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিল।
আলী ইমাম বলেন, ফ্লোর প্রাইসের প্রভাবে শেয়ারবাজারের কার্যক্রমের গতি কমে যাওয়ায় এ বছর ব্যাংকগুলোর ব্রোকারেজ ফিও কমেছে।
এছাড়াও, বৈদেশিক মুদ্রার চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকার অপ্রয়োজনীয় আমদানির জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করেছিল। ফলে, ওপেনিং লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা থেকেও কমিশন আয় কমেছে।
একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস সুদ আয় এই ক্ষতি পূরণ করতে পারেনি। কারণ সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা সুদ আয়ের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করেছে।
জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত সুদ আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা এবং একই সময়ে বিনিয়োগ আয় ১৮ শতাংশ বেড়ে ৭ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা হয়েছে।
আলী ইমাম বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার খেলাপি ঋণ হিসাব করার নিয়ম শিথিল করেছে। তবুও খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।'
'সুতরাং, খেলাপি ঋণ পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি নিয়মমাফিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে,' বলেন তিনি।
ব্যাংক এশিয়ার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক, জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ১ শতাংশ কমে ৩৪৩ কোটি টাকা হয়েছে।
অন্যদিকে পূবালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে যথাক্রমে ২৭৮ কোটি টাকা, ২৭২ কোটি টাকা ও ২৫৬ কোটি টাকা।
২৬ কোটি টাকা লস করে লোকসানের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ কোটি টাকা।
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতির চাপ ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ব্যাংকিং খাত কিছুটা চাপে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা ৩ মাস আগের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং গত বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।
উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো এসব ঋণের সুদ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আহমেদ বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ থাকায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ব্যাপারে বেশ সাবধানী। তাই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়ে পড়েছে।
এ বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে।
কারণ অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে আগের ঋণ নিয়ে চাপের মধ্যে আছেন। ফলে, তাদের নতুন করে ঋণের প্রয়োজন নেই।
কমিশন আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে এলসি খোলা কমে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে বলে জানান আহমেদ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ৬ হাজার ৯৩৬ কোটি ডলারের এলসি খুলেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম।
তিনি জানান, কিন্তু এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম তারা ভালো মুনাফা করতে পারছে।
'রাজনৈতিক উত্তেজনা কেটে গেলে ব্যাংকিং ব্যবসা আরও ভালো করবে,' বলেন তিনি।
Comments