ইসরায়েলকে বাইডেনের অন্ধ সমর্থন, মার্কিন-মুসলিমদের ক্ষোভ

মিনেসোটায় এক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: রয়টার্স
মিনেসোটায় এক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাতে চরম দুর্দশায় আছেন গাজার নিরীহ বাসিন্দারা। সামগ্রিকভাবে, এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন মুসলিমরা। বিষয়টি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে।

আজ শুক্রবার এ বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তাসংস্থা এএফপি।

এএফপির সাংবাদিকরা চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে বেশ কয়েকজন মার্কিন মুসলমান নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

সোমালি-মার্কিন নাগরিক হাদিয়া বার বলেন, 'ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের অন্ধ সমর্থন' তার চোখ খুলে দিয়েছে'। 

হাদিয়া  আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমরা 'নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর থেকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। ইসরায়েলকে এভাবে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি বৈষম্যমূলক এবং এতে মুসলিম ভোটারদের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব আরও বাড়বে।'

তিনি জানান, ৩০ বছর ধরে ডেমোক্র্যাট পার্টিকে ভোট দিয়ে আসলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে তিনি সমর্থন থেকে সরে আসছেন।

হাদিয়া (৫২) বলেন, 'আমি ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান, কাউকেই ভোট দেব না।'

শিকাগো অঙ্গরাজ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আয়োজিত বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
শিকাগো অঙ্গরাজ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আয়োজিত বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

এ বিষয়ে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফলসচার্চ নিবাসী হেয়ারড্রেসার লিন্ডা শউইশের মত জানতে চায় এএফপি। 

উত্তরে ৪৫ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি মার্কিন নাগরিক বলেন, 'তারা (প্রশাসন) গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।' তিনি জানান, সর্বশেষ নির্বাচনে বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাট পার্টিকে ভোট দিয়েছেন।

তবে ২০২৪ এর আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, 'নিশ্চিতভাবেই কোনো ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে আমি ভোট দেব না। আর যদি ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হন, তাহলে আমি ভোটই দেব না'।

২০২৪ এর নির্বাচনের প্রায় এক বছর বাকি আছে। বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা প্রসঙ্গে আরব ও মুসলিম বংশোদ্ভূত মার্কিনরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ। যার ফলে কিছু অঙ্গরাজ্যের ভোটের চিত্র পালটে যেতে পারে।

কিছু ভোটার এএফপিকে জানায়, ৭ অক্টোবরের হামলার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।

তবে আরও অনেকেই জানান, ইসরায়েলের ওপর তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকলেও দেশটি সেই প্রভাবের সদ্ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি বেসামরিক ব্যক্তিদের দুর্ভোগ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের সাবেক মুখপাত্র ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্যতম কৌশল নির্ধারক ওয়ালিদ শাহিদ বলেন, 'ডেমোক্র্যাট পার্টির সমর্থক মুসলিম ও আরব মার্কিন নাগরিকদের অনেকেরই এসব ঘটনায় হৃদয় ভেঙেছে।'

'তারা দেখছেন, প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের এক চোখে দেখছেন না', যোগ করেন ওয়ালিদ।

ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আয়োজিত বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আয়োজিত বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

এক অনানুষ্ঠানিক হিসাব মতে, মার্কিন জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র এক অংশ মুসলিম। ৪৫ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র এক দশমিক তিন শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করেন। তবে ওয়ালিদ মত দেন, 'হাতে গোনা কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ও কয়েক লাখ ভোটে নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হবে'।

২০২০ এর নির্বাচনে বাইডেন মিশিগান, ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া ও অ্যারিজোনায় জয়লাভ করেন। কিন্তু এসব অঙ্গরাজ্যে মুসলিম ভোটারদের সমর্থন হারালে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পুননির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। 

উত্তর ভার্জিনিয়ার অন্যতম প্রধান মসজিদ দার আল-হিজরাহর ইমাম নাঈম বেগ জানান, ট্রাম্পের শাসনের যন্ত্রণা শেষে তার সম্প্রদায় বাইডেনের ওপর ভরসা রেখেছিল।

তিনি জানান, 'আমরা ভেবেছিলাম, জাতিগত ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট পার্টি আমাদেরকে অনেক কিছু দিতে পারবে।'

তিনি আরও জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমদের প্রতি তার বিদ্বেষ লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা করেননি। উল্লেখ্য, ট্রাম্প মার্কিন নাগরিকদের বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে আসা-যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন।

২০২০ সালের নির্বাচনের পর মার্কিন সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস এক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে জানা যায়, ৬৯ শতাংশ মুসলিম বাইডেনকে ভোট দেন। বিপরীতে ট্রাম্প পান মাত্র ১৭ শতাংশ মুসলিম ভোট।

জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলায় নিহতদের লাশ হাসপাতালের সামনে এনে রাখা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলায় নিহতদের লাশ হাসপাতালের সামনে এনে রাখা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

তবে গাজা থেকে আসা ভয়াবহ সব সংবাদ ও ছবি মুসলিম সম্প্রদায়ের সবার মাঝে হতাশা ও আতংকের সৃষ্টি করেছে বলে জানান ইমাম নাঈম বেগ।

নাঈম বলেন, 'এ মুহূর্তে বলতে পারি, আমি বাইডেনকে ভোট দেব না।'

আগেরবার বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন বলে তিনি 'অত্যন্ত বিব্রত', যোগ করেন নাঈম।

গাজার শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেন খালিদ মেক্কি। তিনি জানান, নিজেদের লোকের পক্ষে কথা বলা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ইসরায়েল গাজার সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না।

৫২ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বলেন, 'আমরা এই দেশকে (যুক্তরাষ্ট্র) ভালোবাসি। এটা আমাদের দেশ।'

'কিন্তু আমাদের হাত রক্তাক্ত হচ্ছে—আমি চাই না আমার নাম এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক', যোগ করেন ফলসচার্চ এলাকার বাওয়াদি গ্রিলের মালিক খালিদ।

এএফপি আরও বেশ কয়েকজন মার্কিন-মুসলিমের সাক্ষাৎকার নেয়, যারা সবাই বলেন, বাইডেন সহমর্মিতা না দেখানোয় গাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। 

ইসরায়েলি বিমানহামলায় নিহত সাংবাদিক আবু হাত্তাবের মরদেহ। ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি বিমানহামলায় নিহত সাংবাদিক আবু হাত্তাবের মরদেহ। ছবি: রয়টার্স

হামাসের হামলার পর ১৬ অক্টোবর মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে চালানো হামলায় যুক্তরাষ্ট্রে ছয় বছরের এক ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশুকে হত্যা করেন জোসেফ কুবা (৭১)। এই ঘটনার পর সেই শিশুর পরিবারকে ফোন করতে পাঁচ দিন সময় নেন বাইডেন । এ ছাড়া,  মার্কিন প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হতাহতের সংখ্যা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। এ বিষয়গুলো মুসলিমদের ক্ষোভের কারণ।

হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে এসব উদ্বেগ নিরসনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারা মুসলিম-বিদ্বেষ কমানোর জন্য বিশেষ কৌশল হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছে।

এমন কী, সাম্প্রতিক সময়ে বাইডেনও ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ নিয়ে সহমর্মিতা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তার কিছু বক্তব্যে বিষয়টি উঠে এসেছে।

তবে আদৌ বাইডেনের এসব উদ্যোগ মুসলিম ভোটারদের মন জয় করতে পারবে কী না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

এ প্রসঙ্গে ৭২ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম মাহদি ব্রে বলেন, 'কথায় নয়, কাজেই বিষয়টির প্রমাণ হবে'।

তিনি জানান, বাইডেনের প্রতি তার সমর্থন ফিরে আসবে, যদি তিনি যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক আহবানের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে যোগ দেন।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago