আদানির সঙ্গে ‘গোপন’ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থ পরিপন্থী
২০১৫ সালের আগে-পরে বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর যতটা না চাহিদা বেড়েছে, তারচেয়ে বেশি বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আরেকটি ব্যয়বহুল চুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল? পরিসংখ্যান বলছে, না।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বাংলাদেশ সফরের ২ মাসের মাথায় ১১ আগস্ট আদানি পাওয়ারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে পিডিবি। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ভেতরেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব ছিল আদানির। কিন্তু সমঝোতার ২ বছর পর ২০১৭ সালে—যখন দেশে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছিল—সরকার ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি কেন করেছিল, এর কোনো যৌক্তিকতাই খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্য ডেইলি স্টারের অনুরোধে আদানির সঙ্গে করা চুক্তিটি পর্যালোচনা করে দেশ-বিদেশের ৩ জন আইন ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, চুক্তিটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং শুধুমাত্র আদানি গ্রুপের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করেই তা করা হয়েছে।
সিডনিভিত্তিক ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্স, অস্ট্রেলেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ টিম বাকলি বলেন, 'এক কথায় এই চুক্তিটিতে কেবল আদানিই জিতেছে। এই চুক্তিটি এতটাই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী যে আমি ভাবছি, কোনো সচেতন মানুষ কেন বাংলাদেশের পক্ষে এই চুক্তিটি সই করবেন।'
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানির সঙ্গে চুক্তিটি সই করেছিলেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তৎকালীন সচিব মিনা মাসুদ উজ্জামান। এই চুক্তিতে সম্মত হওয়ার বিষয়ে সরকারি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ডেইলি স্টার।
এ বিষয়ে বর্তমানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামান বলেন, 'এই বিষয়ে আমার কিছুই মনে নেই। এগুলো সাধারণত চেয়ারম্যানের অনুমোদন হয়ে তারপর সচিবের কাছে আসে। পুরো প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে ছিলাম আমি।'
২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন খালেদ মাহমুদ। তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
বর্তমানে বারাকা পাওয়ারের স্বাধীন পরিচালক খালেদ মাহমুদ বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। বুঝতেই পারছেন, এখন সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ।'
২৫ বছর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, বাংলাদেশ থেকে তার পুরোটাই কেনার 'শর্তহীন ও অপরিবর্তনীয়' নিশ্চয়তা পেয়েই প্রায় ১৪ হাজার ৮১৬ কোটি ভারতীয় রুপি ব্যয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে আদানি পাওয়ার। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আদানির সঙ্গে করা এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার কোনো সুযোগ পিডিবির নেই।
অবকাঠামো বিষয়ক চুক্তির খসড়া তৈরিতে বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের একজন শীর্ষ করপোরেট আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আদানি পাওয়ার যদি চুক্তির কোনো ধারা নাও মানে, তবু পিডিবি চুক্তিটি বাতিল করতে পারবে না। বরং তাদেরকে চুক্তিভঙ্গের প্রতিকার খুঁজতে হবে এবং সেই বিবরণটিও যৌক্তিক ও বিস্তারিত হতে হবে। এমনকি প্রতিকারের জন্য আদানিকে সময় দিতে হবে।'
এমনকি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও আদানিকেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
'এটি অবশ্যই একটি অন্যায্য চুক্তি। এই চুক্তি জননীতির পরিপন্থী', বলেন এই আইনজীবী।
কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে, সরকারের এর আগে কখনো বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) দরকষাকষির অভিজ্ঞতা ছিল না। ডেইলি স্টারের অনুরোধে পায়রা ও রামপাল চুক্তি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ওই দুটি চুক্তিও মানসম্পন্ন নয়, তবে সেগুলোতে অপর পক্ষকে এমন ব্যাপক পরিসরে লাভ দেওয়া হয়নি।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল সব খরচের সব ধরনের বিনিয়োগ ঝুঁকি এই চুক্তির মাধ্যমে পিডিবির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি পাওয়ার কোম্পানি আদানি অন্য যেসব চুক্তি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তিটিতেই পরিবর্তনশীল খরচের (কয়লার দাম, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচ ইত্যাদি) ঝুঁকি অপর পক্ষের কাঁধে চাপানো হয়েছে এবং নিজেদের ওপর নামমাত্র ঝুঁকি রেখেছে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠজন গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে করা চুক্তির সবচেয়ে লুণ্ঠনমূলক দিক রয়েছে কয়লার দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জের (বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া) মধ্যে।
যে কয়লা দিয়ে আল্ট্রা-সুপারক্রিটিকাল প্রযুক্তির এই পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তার দাম নির্ধারণ করা হবে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা সূচক ও অস্ট্রেলিয়ান নিউক্যাসল সূচক অনুযায়ী। দুটো সূচকের গড় দামে প্রতি কেজি ৬,৩৩২ কিলোক্যালরি মানের কয়লার দাম যা হবে, তার ভিত্তিতে ওই মাসের কয়লার দাম নির্ধারণ করা হবে।
'এর মানে হলো, আদানি পাওয়ার যদি ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া অন্য দেশ থেকে কম দামে কয়লা কেনে, আর সূচকের দাম বেশি থাকে, তবে তারা বেশি দাম নিতে পারবে।' এই মন্তব্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমের। তিনি বলেন, কয়লার ক্যালোরিফিক মান তারা কম করে ধরেছে, যাতে বেশি পরিমাণ কয়লা ব্যবহার করতে হয়।
পিপিএতে উল্লেখ করা হয়েছে, পিডিবির কাছে কেজিপ্রতি ৪,৬০০ কিলোক্যালরি মানের কয়লার দাম নেবে আদানি।
টিম বাকলি বলেন, 'আদানি যে কয়লা ব্যবহার করবে, সেই গুণমানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন একটি সূচকে যদি দাম নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তা কীভাবে সেটা ন্যায্য হতে পারে? জ্বালানি বিষয়ে আমার কয়েক দশকের বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতায় দেখা এটিই সম্ভবত এমন একটি চুক্তি, যেখানে আদানির জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত উদার।'
চুক্তি পর্যালোচনাকারী আইনজীবী বলেন, 'যদিও চুক্তিতে সূচক পরিবর্তন করার বিধান রয়েছে, কিন্তু সেটা প্রায় অসম্ভব।'
তিনি বলেন, 'কোনো সূচক যদি প্রত্যাহার হয়ে যায়, পাওয়া না যায় বা অনুপযুক্ত হয়, তাহলে তা পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু এই "অনুপযুক্ত" মানে কী, তা আমরা জানি না।'
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আদানি পাওয়ারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আদানি এন্টারপ্রাইজ ভারতের বৃহত্তম কয়লা ব্যবসায়ী। ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় তাদের নিজস্ব কয়লাখনি রয়েছে এবং গোড্ডা প্ল্যান্টের জন্য কয়লার সম্ভাব্য সরবরাহকারী তারাই।
কয়লার পরিবহন ও এর লজিস্টিক সম্পর্কিত খরচ ব্যাল্টিক এক্সচেঞ্জ ড্রাই ইনডেক্স ও প্ল্যাটস অয়েলগ্রাম বাংকারওয়্যার সিঙ্গাপুরের মতো প্রাসঙ্গিক বৈশ্বিক সূচকগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে একটি ভারতীয় গ্রামে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা উড়িষ্যার ধামরা বন্দরে পাঠানো হবে এবং সেটিও আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন আদানি পোর্টস ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
ধামরা পোর্ট কোম্পানিকে কয়লা আনলোডিং, স্টোরেজ, রেলওয়ে ওয়াগনগুলোতে লোডিং ও বন্দর সম্পর্কিত ডকুমেন্টেশনসহ বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কয়লা ভারতীয় রেলওয়ের ওয়াগনগুলোতে করে ৬৯৫ কিলোমিটার দূরে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাবে।
কয়লা নির্ধারিত গন্তব্যে পাঠানোর এই দীর্ঘ যাত্রার ক্ষেত্রে আর্মস লেন্থ প্রাইসিং হবে কি না, তা জানা নেই।
আর্মস লেন্থ প্রাইসিং একটি আদর্শ প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ক্রেতা ও বিক্রেতা সম্পর্কহীন থেকে লেনদেন করবে যেন উভয়পক্ষের লেনদেনে স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে।
পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা পরিবহন ও সরবরাহের জন্যও পিডিবিকে অর্থ দিতে হয়। তবে এই খরচ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে করা হয় এবং কয়লার চূড়ান্ত দামের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়। ফলে একটি একটি প্রতিযোগিতামূলক খরচ পাওয়ার সুযোগ থাকে।
উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কয়লা সরবরাহকারীর সঙ্গে পিডিবির যাচাই-বাছাই ও বিভিন্ন ছাড়ের বিধান রেখে পৃথক ক্রয় চুক্তি হয়। পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের এক বছর আগে নির্ধারণ করা চাহিদার বিপরীতে এই চুক্তি হয়। তবে চালান (ইনভয়েস) হবে পিডিবির অনুমোদন সাপেক্ষে।
আদানির বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে 'ন্যূনতম অফটেক গ্যারান্টি' রয়েছে, যার ফলে উৎপাদিত বিদ্যুতের অন্তত ৩৪ শতাংশ কিনতেই হবে বাংলাদেশকে। ফলে পিডিবির চাহিদা যদি কমও থাকে বা বিদ্যুৎ না নেয়, তারপরও ওই ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লার খরচ দিতে হবে। একইসঙ্গে গুণতে হবে কয়লা সরবরাহকারী, পরিবহনকারী ও বন্দর অপারেটরদের সব জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ।
পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ নেওয়ার জন্য এমন কোনো ন্যূনতম সীমা নেই।
এই ২টির সঙ্গে আদানির পিপিএর মধ্যে পার্থক্যের আরেকটি প্রধান বিষয় হলো ক্যাপাসিটি চার্জ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বয়লার, টারবাইন ও জেনারেটর কত ঘণ্টার জন্য চালানো হচ্ছে, সে অনুপাতে প্রতি বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একটি ভাড়া দিতে হয়।
যেখানে পায়রা ও রামপালের কর্তৃপক্ষ তাদের মূলধন ব্যয়, ইক্যুইটি রিটার্ন, ঋণের সুদ, অবমূল্যায়ন, কার্যকরী মূলধনের সুদ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে একটি চার্জ নির্ধারণ করেছে, সেখানে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তিতে স্বেচ্ছাচারি একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার ফাইন্যান্স করপোরেশন ও ইউনিট আরইসি থেকে ভর্তুকিযুক্ত হারে ১০ হাজার ৭৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে নির্মিত আদানি গোড্ডা প্ল্যান্ট থেকে পরবর্তীতে যে বিদ্যুৎ কেনা হবে, তাতে পিডিবির জন্য অন্যদের তুলনায় বেশি খরচ হবে।
তবে সরকার যদি সতর্কতার সঙ্গে এই চুক্তি করত, তাহলে হয়তো তা এতটা জনস্বার্থবিরোধী হতো না।
চুক্তি সই হওয়ার ১ বছরেরও বেশি সময় পরে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ৪২৫ হেক্টর জমি নির্ধারণ করেছিল, যেখানে অত্যাধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে আদানি পাওয়ারকে বেশ কিছু কর ও শুল্ক প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যাপাসিটি চার্জ, বিদ্যুতের দাম ও কয়লার দাম কমে আসার কথা। কারণ, এগুলো দাম সব ধরনের কর ও শুল্ক যোগ করেই হিসাব করা হয়েছিল।
কিন্তু চুক্তির ধারা অনুযায়ী, শুধুমাত্র কর, শুল্ক বা ব্যয় যদি বাড়ে, তাহলেই শুধু এই পরিবর্তনগুলো হবে। কমলে সেটা সমন্বয় হবে না, যা চুক্তিটি একপাক্ষিক হওয়ার আরেকটি যথাযথ উদাহরণ।
ওই আইনজীবী বলেন, 'এই ধারা অযৌক্তিক। এটা অন্যায্যতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষ এই ধরনের ধারার সঙ্গে একমত হতে পারে না।'
টিম বাকলির মতে, অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে কর ছাড় পাওয়ার কারণে ২৫ বছরে আদানির ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ সাশ্রয় হবে।
পায়রা ও রামপাল চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ বা আইন পরিবর্তনের মতো রাজনৈতিক ঘটনাকে 'ফোর্স মেজ্যুর' হিসেবে গণ্য করেছে। অর্থাৎ এ সময়ে কোনো কিছু ঘটলে উভয় পক্ষই একে অপরের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে।
কিন্তু আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, এমন কোনো ঘটনায় বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ না নিতে পারে, ক্যাপাসিটি চার্জ ও জরিমানাসহ সব ধরণের পাওনা তাদের দিতেই হবে। কিন্তু একই কারণে যদি তারা যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে পিডিবিকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য নয়।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ওই আইনজীবী বলেন, 'রাজনৈতিক কোনো কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে আপনি তাদের ধরতে পারবেন না। তাদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ, বিদ্যুতের দামসহ অন্যান্য বকেয়া পরবর্তীতে পরিশোধ করতে হবে।'
'কিছু না করেও তারা টাকা নিয়ে যাবে। এটা এক ধরনের ডাকাতি। এই ধারা একেবারেই বেআইনি। এই ধরনের ধারা দেখার পরে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন', যোগ করেন ওই আইনজীবী।
চুক্তির আরেকটি অযৌক্তিক ধারা হলো যদি রাজনৈতিক কোনো কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেটা মেরামত ও এই সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় পিডিবিকে দিতে হবে।
রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই সম্পূরক খরচ দিতে হবে না। এই খরচের কারণেও আদানির বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যেতে পারে।
আদানির জন্য আরেকটি সুবিধাজনক ধারা হলো গ্রিডে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য প্রথমবারের পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে পারার সুবিধা।
মানসম্পন্ন পিপিএ অনুযায়ী, এই পরীক্ষা একবারই করা হয় এবং সেই ফলাফলটি ৩০০ মাসের জন্য প্রযোজ্য থাকে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে জরিমানা দিতে হয়।
গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আদানি পাওয়ার নিজস্ব খরচে আরেকটি পরীক্ষা করতে পারবে।
নতুন পরীক্ষায় যদি প্রত্যাশিত রিডিং পাওয়া যায়, তবে তারা আগে পিডিবিকে দেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকাও ফেরত নিতে পারবে।
ওই আইনজীবী বলেন, 'চুক্তির প্রতিটি স্তরে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে। তারা এক হাতে দিচ্ছে এবং অন্য হাতে ফিরিয়ে নিচ্ছে।'
২০১৪ সাল থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পদে আছেন নসরুল হামিদ এবং ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে আছেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য জানতে চাইলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশের কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এম শামসুল আলম বলেন, 'এই ধরনের একটি চুক্তিতে সই করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা বিশ্বাস করি, এই চুক্তিতে থাকা দুর্নীতিগুলো চিহ্নিত করার ক্ষমতা আমাদের এজেন্সিগুলোর আছে।'
'চুক্তি বাতিল করলেও কোনো সমাধান হবে না। যারা এই ধরনের চুক্তি করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।'
গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা বাংলাদেশের গ্রহণ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম।
'গোড্ডা থেকে ডেডিকেটেড ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ নিয়ে আসবে, যেটি শিল্প-ঘন অঞ্চল নয় এবং সেখানে এত বেশি বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। ফলে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অব্যবহৃতই রাখতে হবে এবং ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ডলার দিয়ে যেতে হবে', বলেন তিনি।
টিম বাকলি বলেন, 'পুরো চুক্তিটি এশিয়ার এই সাবেক শীর্ষ ধনীকে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া একটি উপহার।'
Comments