হারিয়ে যাওয়া তিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স ও স্ন্যাপচ্যাটের যুগে মাইস্পেস, গুগল প্লাস বা হাইফাইভের মতো সাবেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম জানা মানুষের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তবে যারা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছেন, তাদের কাছে নামগুলো অর্থবহ।
পাশাপাশি হয়তো কেউ কেউ ভাইনের কথাও মনে রাখতে পারেন, যাকে টিকটকের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আসুন এক সময়ের জনপ্রিয় অথচ বর্তমানে হারিয়ে গেছে, এমন তিন সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপারে জানা যাক।
এগুলো হলো- মাইস্পেস, গুগল+ ও ভাইন।
মাইস্পেস
২০০৩ এর আগস্টে টম অ্যান্ডারসন (মাইস্পেসে সবার প্রথম বন্ধু) ও ক্রিস ডিউলফের হাত ধরে মাইস্পেসের যাত্রা শুরু। মাইস্পেসের সঙ্গে ফেসবুকের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনলাইনে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, কনটেন্ট শেয়ার করা ও ব্যক্তিগত প্রোফাইলে ব্লগ শেয়ার করার সুযোগ ছিল এতে।
এইচটিএমএল ও সিএসএস প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের জ্ঞান থাকলে মাইস্পেস প্রোফাইল এডিট করে একে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যেত, যা ছিল এই প্ল্যাটফর্মের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
পুরনো ব্যবহারকারীদের হয়তো 'টপ এইট ফ্রেন্ডস' নামের অভিনব ফিচারটির কথাও মনে থেকে থাকবে। এতে প্রতিদিন ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল পেজে আট ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রোফাইল প্রদর্শন করতে পারতেন। অনেক শিল্পী মাইস্পেসকে তাদের ব্যক্তিগত প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কেউ কেউ তাদের শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ তৈরির প্রাথমিক কৃতিত্ব মাইস্পেসকেই দিয়েছেন।
শুরুর দিকে মাইস্পেস এগিয়ে চলছিলো দুর্দান্ত গতিতে৷ ২০০৬ সালের দিকে এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ওয়েবসাইট ভিজিটের দিক থেকে গুগলকেও অতিক্রম করে গিয়েছিলো মাইস্পেস। এই দশকের শেষভাগে মাইস্পেসের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় ফেসবুক। ফেসবুকের তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ ইন্টারফেস, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার উন্নত প্রক্রিয়া ও বাস্তব জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে সহজেই সংযুক্ত থাকার সুযোগের ফলে ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ মাইস্পেস থেকে দূরে যেতে থাকেন।
২০১১ সালে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী সংস্থা স্পেসিফিক মিডিয়ার কাছে মাইস্পেসকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের তালিকায় ছিলেন বিশিষ্ট গায়ক জাস্টিন টিম্বারলেক। তিনি নতুন মালিকদের সঙ্গে নিয়ে মাইস্পেসকে আবারো আগের মতো প্রভাবশালী করতে তুলতে চেয়েছিলেন৷ নতুন ইন্টারফেস, গান শোনার জন্য ডিসকভারি ইঞ্জিন ও মোবাইল সাপোর্ট দিয়ে একে ভিন্নধর্মী করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন তারা। তবে মাইস্পেস আর কখনোই আগের জায়গায় ফিরতে পারেনি, বরং হারিয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এখনো কাগজে কলমে এর অস্তিত্ব রয়েছে, তবে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে।
গুগল প্লাস
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় সবারই গুগল বা জিমেইল অ্যাকাউন্ট আছে৷ প্রযুক্তি বিশ্বে গুগল সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের অন্যতম—তাদের সাফল্যের গল্পের শেষ নেই। তবে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের মতো গুগলেরও রয়েছে কিছু ব্যর্থতার ইতিহাস। ফেসবুকের অন্ধ অনুকরণে তৈরি গুগল প্লাস বা গুগল+ ও তেমনই এক ব্যর্থ প্রকল্প।
২০১১ সালের জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা গুগল+ ছিল গুগলের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক ও টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে এসেছিলো এটি। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ফিচার, যেমন- সামাজিক যোগাযোগরক্ষা, কনটেন্ট শেয়ার ও অনলাইনে মেসেজিং সুবিধা।
গুগল + এর লক্ষণীয় ফিচারের ভেতর ছিল ফেসবুক পেজের মতো 'সার্কেলস', গ্রুপ ভিডিও চ্যাট সুবিধা 'হ্যাংআউটস' ও ফেসবুকের গ্রুপের মতো 'কমিউনিটিস'। ফেসবুকের লাইক বাটনের মতোই গুগল+ এ ছিল +1 বাটন, যা দিয়ে কোনো পোস্ট বা কনটেন্টে প্রতিক্রিয়া দেখানো হতো।
গুগলের অন্য সব সেবার সঙ্গে সমন্বয়য় করে গুগল প্লাস ব্যবহার করা যেত।
তবে অনেক ভালো ফিচার ও গুগলের সব সেবার সমন্বয়য় থাকা সত্ত্বেও এটি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো জনপ্রিয়তা পায়নি। ফেসবুকের মতো মাধ্যম থেকে ব্যবহারকারীরা সরে যেতে চাননি। এছাড়া গুগল+ ও এর ব্যবহারকারীদের যুক্ত করা, ইন্টারফেস ব্যবহার ও গোপনীয়তা রক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে সমালোচিত হয়।
২০১৮ এর অক্টোবরে গুগল জানায় তারা গুগল+ বন্ধ করে দিচ্ছে, কারণ এতে ব্যবহারকারীদের কিছু ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছিলো।
অবশেষে ২০১৯ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয় গুগল প্লাস।
ভাইন
২০১৩ তে যাত্রা শুরু করা ভাইনকে খুব সহজেই টিকটকের পূর্বসূরি বলা যায়। এতে ব্যবহারকারীরা ছয় সেকেন্ডের লুপ ভিডিও ক্লিপ তৈরি ও শেয়ার করতে পারতেন।
মাত্র ছয় সেকেন্ডের জন্য হলেও ব্যবহারকারীদের সৃজনশীলতা দেখানোর সুযোগ দিয়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় ভাইন।
এখন টিকটক, শর্টস ও রিলসের কল্যাণে শর্ট ভিডিও খুব প্রচলিত। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে ইন্টারনেটে বহু কনটেন্ট ক্রিয়েটর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই ধারার প্রবর্তন করে ভাইন।
শুধু এর অভিনবত্বের জন্যই নয়, ব্যবহারকারীরা একে মনে রেখেছে এর সোজাসাপ্টা, ব্যবহার অনুকূল ইন্টারফেসের জন্যও। ব্যবহারবিধি সহজ হওয়ায় এটি বড় পরিসরের অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছেছিলো, এতে প্রত্যেকে নিজেদের মতো কনটেন্ট তৈরি করে শেয়ার করতে পারতেন। এর 'সিগনেচার' হিসেবে থাকা ভিডিও লুপিং ফরম্যাটের সঙ্গে স্টপ-মোশন ও টাইম-ল্যাপ্স এর মতো মজার টুলস ব্যবহার একে গণমানুষের কাছে সৃজনশীল গল্প-বলিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম করে তুলেছিল।
তবে সবকিছুরই শেষ আছে। ভাইনের তৎকালীন সত্ত্বাধিকারী টুইটার (বর্তমানে এক্স নামে পরিচিত) আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। ভাইনের খরচ বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়া মনেটাইজেশন নীতির দিক থেকেও সমস্যায় পড়ে ভাইন। ব্যবহারকারীরা কন্টেন্ট আপলোড করলেও সেখান থেকে আয় করতে পারছিলেন না। যার ফলে প্রতিভাবান ক্রিয়েটররা ধীরে ধীরে ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট ও ইউটিউবে চলে যায়।
২০১৬ এর অক্টোবরে টুইটার আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইন বন্ধ করে দেয়। এখনো ভাইনের ভক্তরা তাদের প্রিয় প্ল্যাটফর্মের অকাল মৃত্যুর জন্য অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে থাকে। তবে ভাইন থেমে গেলেও এর আত্মা যেন বেঁচে রয়েছে টিকটকের মাঝে।
ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ করেছেন মাহমুদ নেওয়াজ জয়
Comments