ইসলামী ব্যাংক কি ২০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারবে
ইসলামী ব্যাংক সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে মোট ২০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের যে শেয়ার আছে তা বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। বাকি টাকা নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সংগ্রহ করবে ব্যাংকটি।
তবে শেয়ার বিক্রি ও ইস্যু করে এত বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বিশেষ করে দেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ অবস্থা ও চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এত বড় অর্থ সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বলেন, এস আলম গ্রুপের খপ্পরে পড়ার পর ব্যাংকটিতে সুশাসন ছিল না। ফলে আইএফসি ও আল-রাজি সৌদি গ্রুপের মতো বিদেশি শেয়ারহোল্ডার বের হয়ে যায়।
তবে জানুয়ারির মধ্যে তাদের আবার বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানান ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডিং প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম ও তার সহযোগীরা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক।
ইসলামী ব্যাংকের ১৬০ কোটি শেয়ার আছে, যার বাজারমূল্য আট হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বা প্রতি শেয়ারপ্রতি প্রায় ৫৩ টাকা।
সুতরাং ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের এক-তৃতীয়াংশের মালিকানা এস আলম গ্রুপের কাছে থাকলে বাজারদর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
তাই এই শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে হলে বিক্রয়মূল্য তিনগুণ বেশি হতে হবে।
কিন্তু ব্যাংকটি সম্প্রতি বলেছে, চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি ব্যাংকটির প্রায় ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক এবং ছদ্মনাম ব্যবহার করে শেয়ার কিনে নিজেদের অংশীদারিত্বকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে।
কিন্তু এই ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানার তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হলেও বাজার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ব্যাংকটি যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে চাচ্ছে তা পেতে হলে দাম দ্বিগুণ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ যে উদ্যোগ নিয়েছে তার উদ্দেশ্য ভালো।
তিনি বলেন, 'তবে শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। বিকল্প হিসেবে সরকার যদি নিয়ম-নীতি মেনে শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে তাহলে ব্যাংক কিছুটা স্বস্তি পাবে।'
সুশাসনের অভাব দেখার পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরতে রাজি হবেন কিনা তাও স্পষ্ট নয়। ২০১৭ সালে সরকারি সংস্থার সহায়তায় ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর দেশের সবচেয়ে লাভজনক বেসরকারি ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগীরা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার অর্ধেকের বেশি ঋণ নিয়েছে।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ধীরে ধীরে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ফলে ব্যাংকটিতে বিদেশি মালিকানা কমে যায়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকটিতে বিদেশি শেয়ারের পরিমাণ আট দশমিক ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এস আলমের কবলে পড়ার আগে ছিল ৭০ শতাংশ।
বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), আল-রাজি কোম্পানি, সৌদি ভিত্তিক কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিস্ট এজেন্সি এবং সৌদি আরবের নাগরিক ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-রাজি ও আবদুল্লাহ আবদুল আজিজ আল-রাজি গত বছর তাদের পুরো শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকটির বোর্ড ছাড়েন।
নতুন শেয়ার ইস্যু করার ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন আনিস এ খান। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা বেশ নাজুক। তাই ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বড় অর্থ সংগ্রহ করা বেশি কঠিন হবে।
শেয়ার ইস্যু ও বিক্রির বিষয়ে এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান আসিফ খান বলেন, এখানে দুটি ব্যাপার আছে, একটি কারিগরি বিষয় ও আরেকটি মূল্যায়নের বিষয়।
তিনি বলেন, 'কারিগরিভাবে ইসলামী ব্যাংক নতুন মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। তবে ব্যাংকটির জন্য এস আলমের শেয়ার বিক্রি ও তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ খেলাপি ঋণ সমন্বয়ের প্রক্রিয়া আরও জটিল হতে পারে।'
তার ভাষ্য, 'মূল্যায়নের বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হবে, বিনিয়োগকারীদের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা বলতে পারব না- তারা আসলে মূল্যায়ন করতে ইচ্ছুক কি না।'
'মূল্যায়ন নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের প্রত্যাশা বেশি বলে মনে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা সঠিক আর্থিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি সম্পর্ক ও কৌশলগত প্রভাবের মতো অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিলে তবেই তাদের সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে,' বলেন তিনি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের যে অবস্থা তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন শেয়ার বিক্রি করা কঠিন হতে পারে।
গত ১৪ বছরে শেয়ারবাজার আগের সর্বোচ্চ অবস্থানকে অতিক্রম করতে পারেনি। ২০১০ সালে রেকর্ড আট হাজার ৯১৮ পয়েন্টে উঠেছিল শেয়ারবাজারে।
'সুতরাং, ব্যাংকটিকে এমন কৌশলগত ক্রেতা খুঁজে বের করা উচিত, যিনি প্রাক-আলোচনার মূল্যে শেয়ার কিনবেন,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'শেয়ার ইস্যুর ফলে শেয়ার প্রতি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখন ব্যাপারটি শেয়ার প্রতি আয় নয়, টেকসই হওয়া উচিত।
তার ভাষ্য, 'ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে তার উদ্দেশ্য ভালো, তবে বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের সামনে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরার সময় এসেছে।'
তিনি ঋণ কমিয়ে বন্ড ইস্যুর সুপারিশও করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকের আগের সুনামকে পুঁজি করে আমানত বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
এদিকে গত সপ্তাহে সাবঅর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য বিএসইসি থেকে অনুমোদন পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক।
তবে সাইফুল ইসলাম বলেন, এই বন্ডের আকার ব্যাংকের আকারের তুলনায় ফ্যাকাশে।
তিনি ব্যাংকটিকে কিছু চিরস্থায়ী বন্ডসহ আরও বন্ড ইস্যুর পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের ফোন করে বা খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।
Comments