বিদেশি ঋণ আসার তুলনায় পরিশোধের খরচই বেশি

বৈশ্বিক সুদের ক্রমবর্ধমান হার ও প্রচুর বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে গত জুলাই ও আগস্টে বিদেশি ঋণ পরিশোধের খরচ এর আগের বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেড়ে ৫৮৯ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পাওয়া নতুন ঋণের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি দেশের রিজার্ভকে আরও চাপে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক সুদের ক্রমবর্ধমান হার ও প্রচুর বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে গত জুলাই ও আগস্টে বিদেশি ঋণ পরিশোধের খরচ এর আগের বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেড়ে ৫৮৯ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।

একই সময়ে দেশটি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ৪৫৮ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম।

সামগ্রিকভাবে, বিদেশি সংস্থাগুলোর দেওয়া ঋণ ছিল ১৩১ মিলিয়ন ডলার। এটি সরকারের ঋণ পরিশোধের খরচের তুলনায় কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. দ্বীন ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত জুলাই ও আগস্ট দেশের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনাবহুল মাস। পরিবর্তনের পাশাপাশি অনিশ্চয়তাও ছিল। সেসময় ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি ও বিতরণ কম হবে এটাই স্বাভাবিক।'

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুসারে, ঋণদাতাদের সামগ্রিক প্রতিশ্রুতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি এক বছর আগে ছিল এক দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।

এমন এক সময়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যখন রিজার্ভ বাড়াতে ও টাকার বিনিময় হারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে দেশ হিমশিম খাচ্ছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঋণদাতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই তা দ্রুত পেতে হবে।'

'রিজার্ভের ওপর এসব বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ যাতে কম হয় সেজন্য মন্ত্রণালয়কে তা করতে হবে' বলেও মনে করেন তিনি।

তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সরকার-সরকার কাঠামোর আওতায় নেওয়া দ্বিপক্ষীয় ঋণ পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করা, যাতে আমদানি খরচের ওপর মধ্যমেয়াদি চাপ কমানো যায়।

এই মুহূর্তে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা বড় কিছু নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে।'

আগামী পাঁচ বছরে বার্ষিক ঋণ পরিশোধে কী পরিমাণ খরচ হতে পারে তা বুঝতে ইআরডিকে পাঁচ বছরের প্রক্ষেপণ প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন 'এটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে।'

গত জুলাই ও আগস্টে জাপান সবচেয়ে বেশি ১৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে ১১৭ মিলিয়ন ডলার।

তবে এ সময় এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

অধ্যাপক মো. দ্বীন ইসলামের মতে, 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার মানে দাঁড়ায় উন্নয়ন অংশীদাররা এখন সহায়তা দিতে আগ্রহী।'

যেমন, বিশ্বব্যাংক আরও দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এডিবি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য সংস্থাও বাংলাদেশের চলমান সংস্কারে আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে।

দ্বীন ইসলাম আরও বলেন, 'আশা করা হচ্ছে, এই প্রচেষ্টা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়ে দেবে। স্থবির হয়ে থাকা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশকে আরও ভালো অবস্থানে যেতে হবে।'

তিনি ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের খরচকে বিগত সরকারের নির্বিচারে ঋণ নেওয়ার পরিণতি বলে অভিহিত করেছেন।

দেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের খরচ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের পর থেকে সামগ্রিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে।

গত অর্থবছরে তিন দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এটি এর আগের অর্থবছরের দুই দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি।

অধ্যাপক মো. দ্বীন ইসলাম মনে করেন, রেমিট্যান্স আসা ইতিবাচক প্রবণতা। উন্নয়ন সহযোগীদের নতুন ঋণ দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে।

'মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির মতো মূল সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবকে কমাবে।'

তবে নতুন ঋণ যথাযথভাবে খরচ করা না হলে এবং দুর্নীতির কারণে ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ খোয়া গেলে ডলারের বাজারে ভারসাম্যহীনতা আরও বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতির চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলেও মত দেন তিনি।

'অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ঋণের যথাযথ ব্যবহার জরুরি' বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক দ্বীন ইসলাম।

Comments