যেসব কারণে ঝুঁকিতে অর্থনীতি

গত এক বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ার পাশাপাশি এর প্রভাব আরও বাড়তে পারে বলে অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (এমটিএমপিএস) বলা হয়েছে, এর ফলে সরকারি খাতে ঋণ আরও বাড়বে এবং টাকার আরও অবমূল্যায়ন হবে।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও সরকারের গ্যারান্টি দেওয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঋণ সর্বজনীন নিশ্চয়তাযুক্ত ঋণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।

এখন আগামী অর্থবছরে যদি টাকার ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়, তাহলে ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে টাকার প্রায় ২১ দশমিক ৩ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এর এক বছর আগে অবমূল্যায়নের হার ছিল ৫ শতাংশ।

মধ্যমেয়াদি নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'সামগ্রিকভাবে বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের ফলে আর্থিক বোঝা মধ্যমেয়াদে কিছু পরিমাণে বাড়তে পারে।'

যদিও এতে বলা হয়েছে ঋণের মাত্রা সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে থাকবে, তবে অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'জিডিপি অনুপাতের সঙ্গে ঋণ সেবা খুব একটা কাজে আসে না। কারণ ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে।'

এদিক দিয়ে সরকার পিছিয়ে আছে।

অর্থ বিভাগের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের কর-টু-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সমকক্ষ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।

'২০২০-২১ অর্থবছরে এই হার ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধির পরে রাজস্ব গত বছর ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০৩১ ও ২০৪১ সালের জন্য নির্ধারিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন', উল্লেখ করা হয়েছে মধ্যমেয়াদি নীতি বিবৃতিতে প্রতিবেদনে।

'তবে সম্ভাব্য অবমূল্যায়ন আমদানি-সম্পর্কিত করের মাধ্যমে রাজস্বের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।'

টাকার তুলনায় ডলারের দাম বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি কমবে এবং আমদানি সংক্রান্ত ট্যাক্সপ্রাপ্তিও কমে আসবে। অবমূল্যায়নের ফলে সরকারের ব্যয়ও বাড়বে।

এসবের ফলে ব্যয়ের দিক সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে সারের ভর্তুকি, তেল আমদানির জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে দেওয়া অর্থ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বৈশ্বিক অর্থায়নকৃত অংশ ও বৈশ্বিক ঋণের সুদ প্রদান।

'বৈদেশিক মুদ্রার হারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সরকারের ভর্তুকি ব্যয়কে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে।'

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মূল্যায়নে দেখা গেছে, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেড়ে যাবে।

এর ফলে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়তে পারে।

'অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে মেগা প্রকল্প, আমদানি করা পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সেই কারণে বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে।'

অবমূল্যায়নের আরও ঝুঁকি রয়েছে বলে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তার ভাষ্য, 'সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে উপস্থাপিত বিনিময় হারের ওঠানামা থেকে উদ্ভূত ঝুঁকির বিশ্লেষণ বিস্তারিত হলেও অ্যাকাউন্টিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অসম্পূর্ণ।'

সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবৃতিতে মূলত সরকারি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের প্রভাবের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়।

'এর ফলে সরকারি রাজস্ব ও বাহ্যিক অর্থায়নের ওপর একই অপচয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়।'

বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের ফলে আমদানির টাকা মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সব কর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়।

আমদানি মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয়ভাবে উত্পাদিত বিকল্পের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক ঋণ বিতরণের টাকার মূল্যও বৃদ্ধি পাবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, 'কর্তৃপক্ষ বিনিময় হারকে অবমূল্যায়ন করতে না দিলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণটিও আর্থিক ঝুঁকির গভীরে যেতে পারে না। ফলস্বরূপ ডলারের ঘাটতি সমগ্র অর্থনীতিকে সীমাবদ্ধ করে, যা অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মূল্যকে প্রভাবিত করে এবং এর কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষ পরিচালনা ব্যাহত হয়।'

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া ছাড়া বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

সুদের হারের বেধে দেওয়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি কারণ উল্লেখ করে সরকারকে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।

Comments

The Daily Star  | English

A budget without illusions

No soaring GDP promises. No obsession with mega projects. No grand applause in parliament. This year, it’s just the finance adviser and his unemotional speech to be broadcast in the quiet hum of state television.

7h ago