সম্পদ কমেছে শামীম ওসমানের, বেড়েছে ঋণ
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এই সংসদ সদস্যের গত ৫ বছরে নিজের সম্পদের পরিমাণ কমলেও বেড়েছে ঋণ। যদিও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে।
গত ২৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমন তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।
হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে শামীম ওসমানের নামে ১০ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল। যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৮ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৭ টাকায়।
বন্ধু ও ব্যাংকের কাছে একক ও যৌথভাবে তিনি দেনা ও ঋণ আছেন ২২ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। ৫ বছর আগে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৭ হাজার ৮১৭ টাকা।
বিএ ও এলএলবি সনদধারী শামীম ওসমান তার আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা দেখিয়েছেন। বর্তমানে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচটি, গতবার ছিল চারটি।
ব্যবসা খাতে তার আয় সামান্য বেড়েছে। গতবার ব্যবসা খাতে শামীম ওসমানের আয় ছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, যা এবার কিছুটা বাড়িয়ে ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫২ টাকা দেখানো হয়েছে।
তবে, স্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৭৫০ টাকা এবারও অপরিবর্তিত রয়েছে শামীম ওসমানের।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এর আগে ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, দাঙ্গা সংঘটনের অভিযোগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে মোট ১৭টি মামলার তালিকা তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
মামলাগুলোর মধ্যে ৩টিতে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, ৪টি রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাহার করা হয়। বাকিগুলোতে তিনি খালাস ও অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
শামীম ওসমান তার মালিকানাধীন যে ৫ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হলো-জ্বালানি তেল আমদানি, পরিবহন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেড এন করপোরেশন, শিপিং (পণ্য ও জ্বালানি পরিবহন) প্রতিষ্ঠান জেড এন শিপিং লাইনস লিমিটেড, শিপিং (জ্বালানি পরিবহন) প্রতিষ্ঠান মাইশা এন্টারপ্রাইজ, খান ব্রাদার্স ইনফোটেক লিমিটেড এবং উইসডম নিটিং মিলস লিমিটেড।
খান ব্রাদার্স ইনফোটেক লিমিটেড এবং উইসডম নিটিং মিলস লিমিটেড তার নতুন দুই প্রতিষ্ঠানের নাম গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিল করা তালিকায় ছিল না।
আগের নির্বাচনের সময় শীতল এসি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের নাম উল্লেখ থাকলেও, এবার তালিকায় সেটি নেই।
শামীম ওসমান তার ব্যবসা বাবদ ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫২ টাকা আয় দেখিয়েছেন। ৫ বছর আগে তার এই খাতে আয় ছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
শামীম ওসমান কৃষিখাতে কোনো আয় দেখাননি, যদিও হলফনামায় তার নামে সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের চরহাজী গ্রামে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১২৩ শতাংশ কৃষি জমি আছে বলে উল্লেখ করেছেন।
হলফনামায় তিনি বাড়ি বা দোকান ভাড়া বাবদ আয় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ করেছেন, যা ৫ বছর আগে ছিল ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬৪ টাকা।
তার শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদ হিসেবে আয় ১৫ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪১ টাকা দেখানো হয়েছে। এ খাতে আগের নির্বাচনী বছরে দেখানো হয়েছিল ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮১ টাকা।
এছাড়া হলফনামায় পারিতোষিক এবং সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানী বাবদ আয় যথাক্রমে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা দেখিয়েছেন শামীম ওসমান।
অস্থাবর সম্পত্তি
চলতি বছরের ৩০ জুনের হিসাবে শামীম ওসমান হলফনামায় নগদ টাকার পরিমাণ দেখিয়েছেন ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫৯২ টাকা। একইসঙ্গে তার কাছে বৈদেশিক কোনো মুদ্রা নেই বলে উল্লেখ করেছেন।
চলতি বছরের ৩০ জুনের তথ্য অনুযায়ী, তার নামে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি হিসাবে ৭৩ লাখ ৪ হাজার ৬৮৯ টাকা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। একই ব্যাংকে আরেকটি হিসাব নম্বর উল্লেখ করলেও তাতে কত টাকা জমা আছে, তা উল্লেখ করেননি তিনি।
এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র ও শেয়ার বাবদ শামীম ওসমানের নামে রয়েছে ৩ কোটি ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫৪ টাকা। পাঁচ বছর আগে এই খাতে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯০ টাকা।
তার নামে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি হিসেবে ২ কোটি ৪৯ লাখ ১ হাজার ৬৪৬ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) আছে। পাঁচ বছর আগে আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংকের ৪টি হিসাবে ৪ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৯ টাকার স্থায়ী আমানত ছিল।
আগে ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬৬ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি ছিল শামীম ওসমানের। এবার, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৮১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার আরেকটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি।
এছাড়া, তার নামে ৫ লাখ টাকার বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ৫ লাখ টাকার আসবাবপত্র, ৩৮ তোলা স্বর্ণ রয়েছে (যার মূল্য উল্লেখ করা হয়নি)।
আগে, শামীম ওসমানের একটি 'এনপিবি পিস্তল' ছিল। এবার এর সঙ্গে ২২ বোরের আরেকটি রাইফেলও যুক্ত হয়েছে।
স্থাবর সম্পত্তি
কৃষি, অকৃষি, বাড়িসহ শামীম ওসমানের নামে স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৭৫০ টাকা। তবে, এই তালিকায় ফতুল্লার গাবতলী এলাকায় ১০ শতাংশ জমির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৭৫০ টাকা।
দেনা ও ঋণ
বিদেশি বন্ধু, ব্যাংক, গাড়ির ঋণ ও ক্রসচেকের মাধ্যমে শামীম ওসমানের দায়-দেনার পরিমাণ ২ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। ৫ বছর আগে তার দেনা ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫০ টাকা।
এছাড়া যৌথভাবে আইএসআইসি ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় জেডএন শিপিং লাইনস ও মাইশা এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে মোট ২০ কোটি টাকা ঋণ আছে তার।
৫ বছর আগে জেডএন শিপিং লাইনস, শীতল এসি ট্রান্সপোর্ট ও মাইশা এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ১২ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৭ টাকা ঋণ ছিল শামীম ওসমানের।
গত ১০ বছর ধরে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তার নামে দেনা ও ঋণের পরিমাণ বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।
স্ত্রী-কন্যার আয় ও সম্পদ
শামীম ওসমান তার ওপর নির্ভরশীল হিসেবে তার স্ত্রী ও মেয়েকে দেখিয়েছেন। তবে তার এক ছেলেও রয়েছে। তাকে নির্ভরশীল হিসেবে দেখানো হয়নি।
শামীম ওসমানের স্ত্রী নারায়ণগঞ্জ মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান লিপির ব্যবসা ও শেয়ার সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানতের সুদ খাতে আয়ের পরিমাণ ৬১ লাখ ১০ হাজার ৯৩৯ টাকা। একইখাতে শামীম ওসমানের আয়ের পরিমাণ কম। তার এই খাতে আয় ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৩ টাকা।
৫ বছর আগে তার স্ত্রীর একইখাতে আয় ছিল ৩৯ লাখ ৩৪ টাকা।
একইখাতে শামীম ওসমানের মেয়ের আয় ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৯ টাকা। ৫ বছর আগে সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিল করা হলফনামায় শামীম ওসমানের মেয়ের কোনো আয় দেখানো হয়নি।
স্ত্রী ও কন্যার ব্যবসা খাতে আয় দেখানো হলেও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি।
শামীম ওসমানের স্ত্রীর নামে নগদ, ব্যাংকে রাখা অর্থ, স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ারসহ বিভিন্ন খাতে মোট অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা, যা ৫ বছর আগে ছিল ৭ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৫৮ টাকা ছিল।
এই খাতে তার কন্যার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার ৬১৬ টাকা। ৫ বছর আগে মেয়ের নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও, শামীম ওসমানের ওপর নির্ভরশীলদের নামে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ ছিল।
শামীম ওসমানের স্ত্রীর নামে পিতা থেকে প্রাপ্ত ১৫ শতাংশ জমি ব্যতীত কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
Comments