বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন উদ্বেগ

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২০২০ সালের পর থেকে দ্রুত বেড়ে চলেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন এক সময় এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতির দিকে।

বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমষ্টিগত ভাবে ২৫ দশমিক ৯৫ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।

জুন পর্যন্ত, সব ধরনের বিদেশি ঋণের মধ্যে স্বল্পকালীন ঋণ ছিল ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এসব স্বল্পকালীন ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ বছর।

বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বল্পকালীন বিদেশি ঋণ পরিশোধের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। উল্লেখ্য, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ ত্রৈমাসিকের পর থেকেই ক্রমবর্ধমান আমদানি বিলের কারণে রিজার্ভ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় আছে।

এক বছর আগে রিজার্ভে ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকলেও এ মুহূর্তে আছে ৩৮ বিলিয়ন ডলারেরও কম।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত মহামারির সময় বড় আকারের বিদেশি ঋণ নেয়। সেসময় লাইবোর (লন্ডন আন্তব্যাংক বিনিময় হার) ও অন্যান্য বেঞ্চমার্ক সুদের হার ১ শতাংশেরও নিচে নেমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেঞ্চমার্ক হার ও এর সঙ্গে বাড়তি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হারে বিদেশি ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেয়।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। বৈদেশিক বাজারে বেঞ্চমার্ক হার ৩ শতাংশেরও বেশি। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মন্দা থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বের হয়ে আসার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঋণের হারে এ ধরনের তারতম্য দেখা দিয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তাদেরকে সহায়তা করতে হবে।

এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গভীর সংকটের মুখে পড়বে।

অর্থনীতিবিদ আহসান বলেন, 'ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত বিদেশি ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করা, যাতে তারা তাদের জন্য সুবিধাজনক সময় ঋণ পরিশোধ করতে পারে, বিশেষত, চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অবসানের পর।'

তিনি আরও জানান, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতাও ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১ বছরে আন্তব্যাংক প্ল্যাটফর্মে টাকার মান ২৫ শতাংশ কমেছে। গতকাল ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা, যেটি ১ বছর আগেও ৮৫ টাকা ২৫ পয়সা ছিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা মনসুর আরও জানান, বৈশ্বিক সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঋণগ্রহীতাদের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বহুজাতিক উৎস থেকে তহবিল জোগাড় করতে পারবে, তারা চলমান সংকটের মাঝেও তেমন কোনো সমস্যায় পড়বে না।

'তবে যদি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় বাজার থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার জোগাড়ের চেষ্টা চালায়, তাহলে তারা বড় সমস্যার মুখে পড়বে', যোগ করেন তিনি।

জুন পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাত ৪ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে।

যেহেতু জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে না, এই বিদেশি ঋণ পরিশোধ করার জন্য তাদেরকে স্থানীয় উৎস থেকে তহবিল জোগাড় করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান জানান, দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বিদেশি ঋণের ওপর নজরদারি বাড়ানো।

'কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে পুরো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে', যোগ করেন তিনি।

তিনি জানান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে ঝুঁকির কথা চিন্তা না করে ঋণ নিয়েছে, তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।

'সুতরাং, তহবিলের অপব্যবহার রোধে কারা, কী কাজে ঋণ নিচ্ছে, তার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর রাখা উচিত', যোগ করেন তিনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে পণ্য সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে, যার কারণে দেশের রপ্তানি খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে।

যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বাধাবিপত্তির কারণে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশের আমদানি বিলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি বিল বাবদ ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা একটি নতুন রেকর্ড। অন্যদিকে, রপ্তানি আয় এসেছে ৪৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

40m ago