এস আলমের আয়কর রিটার্নে বৈদেশিক আয় দেখানো হয়নি
এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ২০২২-২০২৩ আয়কর বিবরণী যেন এক 'ধাঁধা'। ওই করবর্ষে তিনি ২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার ব্যক্তিগত সম্পদ দেখালেও কোনো ব্যক্তিগত ব্যাংক ঋণ বা বৈদেশিক আয় দেখাননি।
তবে তিনি তার 'আত্মীয়দের' কাছ থেকে ২ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তার ট্যাক্স ফাইলটি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এই অত্যন্ত উদার 'আত্মীয়দের' বেশিরভাগই আসলে তার এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন সংস্থা।
এই 'আত্মীয়দের' মধ্যে রয়েছে তার নিজের প্রতিষ্ঠান এস আলম অ্যান্ড কোম্পানি, সোনালী ট্রেডার্স, জেনেসিস টেক্সটাইল, এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেড, তার ফুফাতো ভাই আনসারুল আলম চৌধুরীর মালাকানাধীন কোম্পানি মেসার্স আনসার এন্টারপ্রাইজ, তার ভাই ও কোম্পানির পরিচালক ওসমান গণি ও আবদুল্লাহ হাসান প্রমুখ।
ভুয়া কোম্পানির নামে ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনসারুল আলমকে আটক করা হয়।
নিজ মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে বর্তমানে এস আলম নিজেই তদন্তের আওতায় রয়েছেন। সরকারও তার অফশোর সাম্রাজ্য খতিয়ে দেখছে।
গত বছর ডেইলি স্টারের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে অন্তত ১০০ কোটি ডলারের ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি, যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা কোনো তহবিল স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার কোনো রেকর্ড নেই।
সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড করপোরেট রেগুলেটরি অথরিটির কাছে তার কোম্পানির ২০২১ সালের জমা দেওয়া কাগজপত্রে এই ১০০ কোটি ডলারের হিসাব দেওয়া হয়েছে। ডেইলি স্টার এখন তার ২০২২ সালের হিসাবপত্রের কাগজ পেয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সেখানে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ১৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এস এস পাওয়ার ভুয়া চালান ব্যবহার করে দুটি এলসির মাধ্যমে চীনে ৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলার (প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা) পাচার করেছে। বিষয়টি এখন তদন্তনাধীন।
চলতি বছরের আগস্টে এই পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা নিয়ে গেছে, যার ৭৯ শতাংশই এসেছে ইসলামী ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশে তার ২০২২-২৩ সালের কর নথি থেকে জানা যায়, এস আলম তার তিন ছেলে, মা, ভাই এবং তার নিজের মালিকানাধীন ১১টি কোম্পানিকে ৩৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন।
আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের সবচেয়ে বড় অংকটি ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা এসেছে তার নিজেরই প্রতিষ্ঠান এস আলম অ্যান্ড কোং থেকে। তার মোট দায় ২ হাজার ২১৫ কোটি টাকা, যেখানে গতবছর তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩০৩ কোটি টাকা।
তবে তার ট্যাক্স রিটার্নে কোনো বৈদেশিক আয় দেখা যায় না, যদিও তার সিঙ্গাপুরের কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে দেখা যায় সেখানে তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য প্রসারিত হচ্ছে।
তার কোম্পানি উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়া বছরে ৭৭ মিলিয়ন ডলার বা ৯২৪ কোটি টাকার বেশি বার্ষিক টার্নওভার করেছে এবং মুনাফা করেছে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার (৩০.৮৫ কোটি টাকা)। ওই সময়টি বাংলাদেশের কর বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে পড়ে, যেখানে এস আলম জানিয়েছিলেন যে তার কোনো বৈদেশিক আয় নেই।
জমা দেওয়া আয়কর বিবরণী অনুয়ায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশি উৎস থেকে তার মোট আয় ছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠা করেন, যার ৭০ শতাংশ সাইফুল আলম এবং বাকি ৩০ শতাংশ তার স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
এই দম্পতি ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর উইলকিনসনের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের পিকক প্রপার্টি হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি অফশোর কোম্পানিতে মালিকানা হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এমন এক ট্যাক্স হ্যাভেন বা কর স্বর্গ যেখানে সবকিছু গোপন রাখা হয় এবং কোম্পানিগুলো কোনো অফিসিয়াল ফাইলিংয়ে তাদের শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালকদের নাম রাখতেও আইনত বাধ্য নয়।
উইলকিনসনের আর্থিক বিবরণীতে আরও বলা হয় ২০২২ সালে কোম্পানিটি ৪৯৮ মিলিয়ন বা ৫ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা অর্থায়ন পেয়েছে।
ডেইলি স্টার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে এস আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
উপ-কর কমশনার আওরঙ্গজেব খান নিশ্চিত করেছেন যে এস আলম তার ট্যাক্স রিটার্নে কখনোই তার বৈদেশিক আয়ের কথা উল্লেখ করেননি।
১৯৮৪ ও ২০২৩ সালের করবিধি অনুযায়ী বৈদেশিক আয়ের ঘোষণা বাধ্যতামূলক। নিয়ম লঙ্ঘনে আর্থিক জরিমানা ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের সাজা হতে পারে।
Comments