ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হারাল এস আলম গ্রুপ

বাংলাদেশ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এস আলম গ্রুপ, আহসান এইচ মনসুর, শেখ হাসিনার পদত্যাগ,

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে সাত বছর পর দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এই সাত বছরে ইসলামী ব্যাংকে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গ্রুপটির।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, লুটপাট যা করার তারা তা করে ফেলেছে। এখন আমাদের কাজ হলো এই বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ব্যাংকটিকে উদ্ধার করা।

ব্যাংকটির বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম গত বছরের জুন থেকে এই পদে আছেন। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বড় ছেলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দু-একদিনের মধ্যে ভেঙে দেবে। এরপর স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়ে একটি নতুন বোর্ড গঠন করবে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

আইন অনুযায়ী এস আলমের দায়ের বিপরীতে সব শেয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে নেবে জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির পাওনা টাকা পরিশোধ করলে চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়ী গ্রুপ তাদের শেয়ার ফেরত পেতে পারে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'কিন্তু আমার মনে হয় না তারা তা করতে চায়।'

ইসলামী ব্যাংকে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপের ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে ব্যবসায়ী গ্রুপটি ৩২ শতাংশ শেয়ার দেখিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের একদল কর্মকর্তা, পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও একদল গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ জানানোর পর বোর্ড ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

ইসলামী ব্যাংক এক সময়ের সুপরিচালিত ও লাভজনক ব্যাংক ছিল। কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পরে এস আলম ব্যাংকটির ওপর প্রভাব খাটাতে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে বেসরকারি ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে।

২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকটি থেকে ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ইসলামীর ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৪৭ শতাংশ।

এসব ঋণের ব্যাপারে অবগত কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রী, মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য কর্মকর্তার নামে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে আসা নথিতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ঋণ ব্যাংকিং বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় এস আলম গ্রুপ দেশের ব্যাংকিং খাতে কীভাবে প্রভাব খাটিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাবেক রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয় সাইফুল আলম ১৯৮৫ সালে এই ব্যবসায়ী গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত করেন। ধীরে ধীরে এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশের বৃহত্তম একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ হয়ে ওঠে।

এদিকে এস আলম ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাব ঘাটতিতে আছে।

অবশ্য এই ঘাটতি মেটাতে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশে ইসলামী ব্যাংককে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই বিশেষ তারল্য সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে গত সপ্তাহে আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই তারল্য সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ইসলামী ব্যাংক ১৯৮৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীদের ৭১ দশমিক ৫০ শতাংশ ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ অংশীদারিতে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে।

২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের কোনো শেয়ার ছিল না। কিন্তু নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সাতটি ছায়া কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাংকটির শেয়ার কেনা শুরু করে ব্যবসায়ী গ্রুপটি।

২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে ৭ হাজার ২৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয় এস আলম গ্রুপ। এদের বেশিরভাগের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়।

কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একদিন পর এস আলমের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদত্যাগের দাবিতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত ১১ আগস্ট দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসময় ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন।

পরে ১৯ আগস্ট এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ আট কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে ব্যাংকটি।

Comments