কর্মক্ষেত্রে জেন-জি, স্বাগত জানাবেন যেভাবে

জেন-জি
ছবি: সংগৃহীত/বনি কিটল/আনস্প্ল্যাস

পৃথিবীর কাজের জগতে বা পেশাগত পরিমণ্ডলে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত নতুন একটি প্রজন্ম, যাদের জন্ম নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে ২০১০ এর দশকের প্রথম দিকে। তাদের ডাকা হয় জেনারেশন জেড বা জেন-জি নামে। এই প্রজন্মের তরুণদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন, বিশেষত পূর্বসূরিদের চেয়ে তাদের ভাবনা একেবারে বিপরীত।

জেন-জির আগের প্রজন্ম, যারা মিলেনিয়াল নামে পরিচিত, তাদের ভেতর দেখা যায়, পূর্বসূরিদের কিছু প্রথাগত বৈশিষ্ট্য রয়েই গেছে। কিন্তু মিলেনিয়াল আর জেন জির মধ্যে বৈশিষ্ট্যে তো মিল নেই-ই, বরং ব্যবধান অনেক বেশি।

মূল্যবোধ, কাজের নৈতিকতা ও যোগাযোগ দক্ষতা থেকে শুরু করে নিজেকে প্রকাশের ভঙ্গিতেও জেন-জি অনন্য। কর্মক্ষেত্রগুলোয় ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে এই প্রজন্মের তরুণরা, সময়ের সঙ্গে যে অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। জেন-জির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এখন থেকেই তাই কর্মক্ষেত্রগুলোর উচিত এই প্রজন্ম সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানো, তাদের বোঝার চেষ্টা করা। যাতে করে তাদের সঙ্গে আরও ভালোভাবে কাজ করা যায়, তাদের কাছ থেকে সেরাটুকু নেওয়া যায়।

কীভাবে আমরা জেন-জিকে কর্মক্ষেত্রে স্বাগত জানাতে পারি, তা বুঝতে চলুন জেনে নিই তাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব করপোরেট জগৎ আসলে তাদের কাছ থেকে কী পেতে পারে।

টেক-স্যাভি বা দারুণ প্রযুক্তিবান্ধব

জেন-জি এমন এক সময়ে বেড়ে উঠেছে যখন বিশ্বজুড়ে ঝড়ের গতিতে চলছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অন্য প্রজন্মগুলোর তুলনায় প্রযুক্তির বিষয়ে জেন-জি অনেক বেশি সাবলীল। সবচেয়ে প্রযুক্তিবান্ধব প্রজন্ম হিসেবে তারা খুব সহজেই বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং এই দক্ষতা খুব সহজেই কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে।

কাজের ধরন

জেন-জি যেন কঠোর নিয়মানুবর্তিতার উল্টোদিকে হাঁটে। বরং তাদের পছন্দ তুলনামূলক নমনীয়-সহনীয় কাজের পরিবেশ। তারা এমন পদ্ধতিতে কাজ করতে ভালোবাসে যেখানে তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা যায় এবং তারা যেন তাদের সেরাটা সেখানে দিতে পারে। শুরুতে এই গুণকে কিছুটা অহংবাদী মনে হতে পারে। কিন্তু জেন-জির দলগতভাবে কাজ করার দক্ষতাও দারুণ। সহযোগী হিসেবেও তারা খুব ভালো।

নিজেদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তারা খুবই স্পষ্টবাদী। এ ছাড়া বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও মতামত প্রকাশে তারা দ্বিধাহীন। পূর্বসূরিদের তুলনায় যুক্তিতর্কের বিষয়ে তারা অনেক বেশি উদার এবং কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে খুব ভালোভাবে বোঝার জন্য গঠনমূলক তর্কে জড়াতেও পিছপা হয় না।

কাজের পরিবেশ

জেন-জির তরুণরা কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পছন্দ করে। সে কারণেই দৈনন্দিন রুটিনে নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, কাজের পরিবেশ চায় নমনীয়; যেন সেটা তার ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত না করে। ফলে হাইব্রিড বা সুবিধামতো স্থানে বসে অফিসের কাজ করার দিকে ঝুঁকছে জেন-জি, যেখানে বাঁধা-ধরা সময়ে নয়, বরং তারা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে কাজ করতে পারবে।

জীবন সম্পর্কে শিথিল দৃষ্টিভঙ্গি দেখে হতবাক হবে না, জেন-জির তরুণরা অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং যেখানেই থাকুক না কেন তারা সেখানে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি করে নিতে সবসময় প্রস্তুত। পাশাপাশি তারা সবসময় নতুন কিছু শিখতে চায়, দক্ষতা বাড়াতে চায়, এমন সুযোগ চায় যেখানে তারা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।

যোগাযোগ

প্রথাগত যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ইমেইল বা টেলিফোনের চেয়ে জেন-জির পছন্দ ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপসহ ডিজিটাল যোগাযোগের অন্যান্য পদ্ধতি। এটাও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ।

স্ল্যাক, মাইক্রোসফট টিমস ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে খুব সহজেই তারা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া স্বভাবগত কারণেই তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পছন্দ করে। এতে সুবিধা হলো গঠনমূলক মতামত দেওয়া যায়, সংলাপের জন্য উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং নতুন কিছু শেখার মানসিকতা থাকার কারণে খুব সহজেই তারা যেকোনো কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে মানিয়ে যেতে পারে।

প্রকাশভঙ্গী

জেন-জির তরুণরা অনেক বেশি অভিব্যক্তিপূর্ণ হয় এবং এই বৈশিষ্ট্য যেন তাদের চেহারাতেই প্রকাশ পায়। পোশাকের ক্ষেত্রেও তারা প্রথা মেনে চলতে আগ্রহী নয়, বরং যেকোনো নিয়মের বাইরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজে যেমন, ঠিক সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে ভালোবাসে জেন-জি। আগের প্রজন্মের মতো অন্যের চোখে নিজেকে সেরা দেখাতে চায় না।

ব্যবধান কমাবেন যেভাবে

জীবন সম্পর্কে জেন-জির যে অনন্য ধারণা আছে, তা হয়তো কর্মক্ষেত্রে কিছুটা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। পরিবর্তন করতে গেলে কিছু বাধা আসবেই, আবার কর্মক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখেও তাদের পড়তে হতে পারে। এসবের কারণে অন্য প্রজন্মের সঙ্গে জেন-জির বোঝাপড়ায় কিছুটা ঘাটতিও দেখা দিতে পারে।

জেন জি-র সঙ্গে অন্যদের এই যে দূরত্ব, তা পূরণে কর্মক্ষেত্রেই সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, এমন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে জেন-জিকে নির্বিঘ্নে মিশে যাওয়ার সুযোগ দিতে হলে সেখানে অন্তর্ভুক্তির সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে উদার হতে হবে, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে যেকোনো বয়সের মানুষের কাজকে মূল্যায়ন করা হবে, যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হবে, কাজের প্রশংসা করতে হবে।

এই পরিবেশ তৈরি করতে সব প্রজন্মেরই চেষ্টার প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে পুরোনোদের আগে এগিয়ে আসতে হবে, প্রথম কদমটি তাদেরই ফেলতে হবে। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন কেবল জেন-জি পুরোনোদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবে না, বরং পুরোনোরাও নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে শিখবে। জেন-জির বয়স কম বলে তাদের মতামত খারিজ করে দেওয়া হবে না বা তাদের অবজ্ঞা করা হবে না।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন টিম-বিল্ডিং অ্যাকটিভিটি বা দলগতভাবে করা যায় এমন কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে বয়স্ক ও তরুণরা একসঙ্গে মিলে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করবেন। এজন্য কর্মশালা বা কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আয়োজন করা যেতে পারে। এর ফলে কেবল যে তাদের প্রজন্মের বাইরে গিয়ে দলগত কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে তা-ই নয়, বরং স্টেরিওটাইপ বা কারও সম্পর্কে কাঠামোবদ্ধ ধারণা ভেঙে দেবে এবং সহানুভূতি তৈরি করবে।

আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রতিষ্ঠানের জন্য জেন-জি অপরিহার্য। কেবল এজন্য নয় যে তারা বর্তমান সময়টাকে বুঝতে পারে, বরং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতেও জেন-জিদের প্রয়োজন।

কর্মক্ষেত্রগুলো যত বিকশিত হবে, যত গতিশীল হয়ে উঠবে, প্রতিষ্ঠানকে তত বেশি পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। যদি ইতিহাস থেকে আমরা কিছু শিখে থাকি, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই উন্নয়নের জন্য জেন-জির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ হলো জেন-জি, তাই আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন তারা কাজের ক্ষেত্রে যথাযথ সুবিধা পায় এবং কর্মক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
CSA to be repealed

Govt will scrap CSA within a week

The Cyber Security Act will be repealed within a week and all cases filed under the act will be withdrawn, Nahid Islam, adviser to the posts, telecommunications, and information technology ministry, said yesterday.

13m ago