ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন

সহকর্মী ও বস হিসেবে জেন-জিরা কেমন

কর্মক্ষেত্রে জেন-জি। ছবি: সংগৃহীত
কর্মক্ষেত্রে জেন-জি। ছবি: সংগৃহীত

জেনারেশন জি (ইংরেজি বর্ণমালার শেষ অক্ষর জেড বা জি) বা সংক্ষেপে জেন-জি তাদেরকেই বলা হয়, যাদের জন্ম মূলত ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মাঝে। জেন-জি প্রজন্মের প্রতিনিধিরা যখন কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে শুরু করে, তখন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে 'কর্মক্ষেত্রের' ধারণা এক বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কর্মক্ষেত্রে জেন-জি প্রজন্মের সদস্যদের বিশেষ আচরণ নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে সহকর্মী হিসেবে, বস হিসেবে জেন-জিদের কার্যধারার অনেক জানা-অজানা তথ্য উঠে এসেছে। 

একাধিক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, কর্মক্ষেত্রের প্রথাগত অনেক ধ্যান-ধারণা জেন-জির সদস্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যের দুরবস্থা এবং কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য চাহিদার প্রতি উদাসীন নিয়োগকর্তা তাদেরকে হতাশ করেছে। 

২০২৪ সালে এসে জেন-জির সদস্যরা এখন 'বস' হতে শুরু করেছেন। তাদের সামনে সুযোগ এসেছে কর্মক্ষেত্রকে নিজেদের পছন্দ-চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বদলে নেওয়ার।

এডিপি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রের ১৬ দশমিক আট শতাংশ জায়গা দখল করেছে জেন-জি। তবে অন্যান্য প্রজন্মের তুলনায় তাদের ক্যারিয়ার বেশি দ্রুত আগাচ্ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এক দশমিক দুই গুণ বেশি জেন-জি পদোন্নতি পেয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার অংশ হয়েছে।

জেন-জির সঙ্গে কাজ করা ঝামেলাপূর্ণ

জেন জি কর্মক্ষেত্র। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
জেন জি কর্মক্ষেত্র। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায় প্রকাশ, জেন-জিদের সঙ্গে কাজ করতে যেয়ে অন্যান্য প্রজন্মের সদস্যরা ঝামেলার মুখে পড়ছেন। রেজ্যুমেবিল্ডার ডট কমের এক হাজার ৩৪৪ ম্যানেজারের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ৭৪ শতাংশই মনে করেন অন্যান্য প্রজন্মের তুলনায় জেন জি'র সঙ্গে কাজ করা বেশি ঝামেলাপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অনুপ্রেরণা, উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। একই ওয়েবসাইটের অপর এক জরিপে দেখা গেছে, নিয়োগদাতাদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ বলেছেন জেন-জিরা অফিসের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয় এমন পোশাক পরেন। ৫৭ শতাংশ বলেন, তাদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে যেয়ে সমস্যা পড়েছেন আর ৪৮ শতাংশ বলেছেন তারা তাদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা বিচারে অনেক বেশি বেতন দাবি করেছে।

তবে এ ক্ষেত্রে যারা জরিপে অংশ নিয়েছেন, তাদের কাছে এ বিষয়গুলো 'দুর্বলতা' মনে হলেও অন্যেরা সেটাকে ভিন্নভাবে বিচার করতে পারেন।

অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী কর্মীরা যে বিষয়গুলোকে কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন, জেন-জিরা সেগুলোকেই শক্তিশালী নেতৃত্বের ইঙ্গিত হিসেবে দেখে।

একজিকিউটিভ প্রশিক্ষক স্কট ডে লং (৬৪) বলেন,  'জেন-জিরা কাজ করতে চায় না, বিষয়টা এমন না। বেড়ে ওঠার সময় বয়স্করা তাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছেন, অফিসে কেউ তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণ করলে তারা আর সেই ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী থাকে না।' অর্থাৎ, জেন-জিরা বস হিসেবে বা জ্যেষ্ঠ কলিগ হিসেবে কাউকে আলাদা করে দেখতে আগ্রহী না। সবার সঙ্গেই একই রকম আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে চায় জেন-জি। সঙ্গে অফিসের ড্রেস কোডও মানতে আগ্রহী নয় তারা।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ সচেতন জেন-জি। 'বার্ন আউট' তাদের কাছে নিত্যদিনের বিষয়।

জরিপে অংশ নেওয়া ৩৭ শতাংশই জানান তারা পেশাদারি মানসিক স্বাস্থ্য-সেবা গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য প্রজন্মের মধ্যে এই হার অপেক্ষাকৃত কম।

অফিসের পরিবেশে পরিবর্তন

জেন জি
ছবি: সংগৃহীত

নিউইয়র্কের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান অগাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সবার বয়স ২০ এর কোঠায়। সেখানে বিজনেস ডেভেলপমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেন এরিন বার্ক, যার বয়স ৩০ পেরিয়েছে। তিনি তার জেন-জি বসদের বিষয়ে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতিষ্ঠাতারা প্রায়ই থেরাপি নেন এবং এ বিষয়টিকে গোপন রাখার কোনো চেষ্টাই করেন না তারা। তাদের 'শেয়ার্ড' ক্যালেন্ডারেই এ ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্টের উল্লেখ থাকে।

তিনি আরও জানান, জেন-জি বসরা অফিস আর বাসার মধ্যে তেমন পার্থক্য রাখেন না। প্রায়ই ঘরে পরার বা জিমে যাওয়ার কাপড় ও জুতা পরে অফিসে চলে আসেন তারা। মুখে ছুটতে থাকে 'নিরবচ্ছিন্ন গালিগালাজ আর অশালীন ভাষা' যা প্রথাগত কর্মক্ষেত্রে কল্পনাই করা যায় না। 

এরিন বলেন, 'আপনার নিজস্ব ব্যক্তি-সত্ত্বা আর অফিসে আপনার আচার-আচরণ ভিন্ন থাকবে, এই ধারণা আরও চার প্রজন্ম আগেই বাতিল হয়েছে।'

তিনি স্মৃতিচারণ করেন, অফিসের কাজে 'স্ল্যাক' মেসেঞ্জারের ব্যবহারে প্রায়ই তিনি 'লাভ' বা হার্ট রিয়েকশন পেতেন এবং খানিকটা অবাক ও অপ্রস্তুত হতেন। ভাবতেন, 'এটা তো আবেগ-অনুভূতির বিষয়। কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে কি এ ধরনের আচরণ ঠিক?'

তবে পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন, সারাদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করলেও আবেগ দেখানোর বা প্রকাশ করার অনেক সুযোগ মেলে জেন-জি প্রতিষ্ঠানে।

গবেষকদের মতে, এটাই জেন-জির মূল বৈশিষ্ট্য। তারা কর্মদক্ষতার চেয়ে বুদ্ধিমত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং কোনো ধরনের আত্মসমালোচনাকে ভয় করে না। জেন-জি কর্মীরা 'এমপ্যাথি' (আপনার আবেগ-অনুভূতি বোঝার ও তার অংশীদার হবার ক্ষমতা) কে একজন বসের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। কিন্তু তাদের অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী বসরা বিষয়টিকে পাঁচে রেখেছে।

জেন-জির তালিকায় 'ধৈর্য' সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, বস হিসেবে আপনার অধীনে জেন-জির কেউ থাকলে তাদের সঙ্গে আপনাকে অবশ্যয়ই ধৈর্যশীল হতে হবে। 

একেকজন কর্মী একেকরকম, আর সেভাবেই ঠিক করতে হবে কাজের ধরন

জেন জি কর্মক্ষেত্র। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
জেন জি কর্মক্ষেত্র। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

কর্মীদের কর্মী হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের ব্যক্তি সত্ত্বার দিকে নজর দিতে হবে। জেন-জি প্রসঙ্গে এটি একটি বড় শিক্ষা। একেকজন মানুষের জীবন, বাস্তবতা ও পরিস্থিতি একেক রকম। সে বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে কাজের ধরন নির্ধারণ করতে পারলেই একটি আধুনিক ও কার্যকর কর্মস্থল তৈরি করা সম্ভব।

আদারশিপ নামে টরন্টো ভিত্তিক বাথহাউস চেইনের মার্কেটিং ম্যানেজার টেলর ফুলটন জার্জিস (২৫) জানান, আট সদস্যের দলের ম্যানের হিসেবে কাজ করে তার অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে।

তিনি জানান, এই আটজনের (বেশিরভাগই জেন-জি) প্রত্যেকের নিজস্ব কাজের ধরন আছে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ধরনটিও ভিন্ন। এই আটজনকে তার কাজে স্টাইলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য না করে বরং তিনি তাদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। 

'কেউ জুম কলে স্বচ্ছন্দ, কেউ ফোনে। কেউ সামনাসামনি কথা বলতে চায়। আবার কেউ কথা না বলে কাজ করে দেখাতে আগ্রহী', বলেন টেলর।

ইমপ্যাক্ট ইলেভেন নামের বক্তা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কনর ট্রম্বলি (২৯) লক্ষ্য করেন, তার ছয় সদস্যদের দলের কেউই সময়মত কাজ শেষ করতে পারছে না। 

তার বসের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলেন, সমস্যা দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার না।

'আমার নিজের কাছে যে প্রত্যাশা, সেই একই প্রত্যাশা আমি আমার দলের সদস্যদের ওপর আরোপ করতে পারি না', বলেন তিনি।

কর্মীদের কথা শুনে ও সে অনুযায়ী কাজের ধরন তৈরি করে অল্পদিনেই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়ায়।

সব মিলিয়ে, জেন-জি'র প্রবেশে কর্মক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। বিষয়টি যত দ্রুত আমলে নেবে নিয়োগদাতারা, ততই মঙ্গল।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh lags behind in rooftop solar race

Despite significant potential for rooftop solar energy, Bangladesh has lagged behind in development, while Vietnam has emerged as a regional leader in the sector

1h ago