ইমপোস্টার সিনড্রোম: নিজেই যখন নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান

ছবি: ফ্রিপিক

'এসব উন্নতি সবই বসের তোষামোদি করে হয়েছে, আমরা কি বুঝি না?', 'আজকাল যারাই প্রমোশন পায়, তারাই দেখো গিয়ে লবিং করছে', 'আরে, ও আর এমন কী গান গায়! এমনিই যত সুনাম ওর।' 

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের কাছ হতে শুনতে হয় বিভিন্ন কটু কথা এবং একটা সময় যেন এসব কথা শুনে শুনে অভ্যাসও হয়ে যায়। অভ্যাস হয়ে যায় অন্যকে এড়িয়ে চলার। অন্যকে এড়িয়ে চলা তেমন একটা কঠিন কাজও নয়। কিন্তু কারও ক্ষেত্রে যদি এই কথাগুলোই অন্য কেউ না বলে নিজেই নিজেকে বলেন? তখন? নিজেকে কি আর এত সহজে এড়ানো যায়? 

ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভোগা ব্যক্তিদের মূল সমস্যা এটাই। নিজের যেকোনো অর্জন, যেকোনো সাফল্যকে তারা মনে করেন এক ধরনের ভাঁওতাবাজি। তাদের ধারণা, এসব সাফল্য তারা নিজের যোগ্যতায় পাননি– বরং ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছেন। এই মানসিক সমস্যাটি আদতে কোনো নিরাময়যোগ্য অসুখ নয়। বরং নিজের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থেকে এমনটা ঘটে থাকে। এই শব্দগুচ্ছটি প্রথম সবার সামনে আনেন মনস্তত্ত্ববিদ সুজানা ইমস এবং পলিন রোজ ক্ল্যান্স। 

ব্যক্তিজীবনে পরিপূর্ণতা আছে কিংবা ক্যারিয়ারে অনেক সফল ব্যক্তির মধ্যেও তার অর্জন নিয়ে কখনো কখনো কিছু প্রশ্ন জন্ম নেয়। প্রশ্নগুলো সাধারণত অনেকটা এমন হয়– 'আমি কি সত্যিই এতকিছুর যোগ্য?'

পাছে লোকে কিছু জানে!

কিংবা 'যদি সবাই জেনে যায় যে, আমি এতটা যোগ্য নই? যদি আমি ধরা পড়ে যাই, তাহলে?' এই ধরনের ভয় নিয়েই তারা দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকে এবং এই ভয়ের নেতিবাচক কিছু প্রভাবও তার আচরণে পড়ে। যেহেতু সে ধরেই নিচ্ছে, তার যোগ্যতা নেই– সেক্ষেত্রে তার কাছে ব্যর্থতার স্বরূপ অনেক বেশি স্বাভাবিক মনে হয়। বেশ কয়েকবার সফল হওয়ার পর একবারও যদি ব্যর্থতার নীলচে আঁধার তার মধ্যে বাসা বাঁধে, তখনই তার মনে হয়– এটাই তো হবার কথা। আমার তো এমনটাই পাওয়ার কথা বরং এতদিনের সব সাফল্যই ছিল মিথ্যা। ব্যক্তিজীবনে, কর্মজীবনে– সম্পূর্ণরূপে তার সামাজিক জীবনেই ইমপোস্টার সিনড্রোম একটা ফাঁপা স্থান সৃষ্টি করে। সেই ফাঁপা স্থানে ব্যক্তি নিজে ছাড়া আর কেউ থাকে না, আর কিছুই থাকে না। ইমপোস্টার সিনড্রোমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে ব্যক্তি গভীর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে, জীবনকে তার ভীষণ অর্থহীন মনে হতে পারে এবং শেষমেশ সে নিজের মধ্যেই গুটিয়ে যায়। 

সমাধানের কোনো উপায় আছে কি?

মজার বিষয় হচ্ছে, যাদের সাফল্য বা দক্ষতা নিয়ে এত ভয়-ভীতি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোই আমাদের চেনাজানা জগতে অনেক বেশি কর্মঠ, অনেক বেশি সফল হয়ে থাকে। কেউ কেউ একে তুচ্ছ করে 'সুখে থাকতে ভূতে কিলায়' এর মতো বাণী ছুঁড়ে দিলেও ইমপোস্টার সিনড্রোম বেশ ভালোই ভোগায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে এবং অন্যদের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন বা সংবেদনশীলতা না পেলে তারা আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত, আমাদের আশেপাশের কেউ, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনের মধ্যে এসব উপসর্গ দেখা দিলে, তাদের বুঝিয়ে বলা। তাদের পাশে থাকা এবং তারা যে নিজেদের অর্জনের মতো কিংবা তার চাইতেও বেশি যোগ্য, সেটি অনুভব করাতে চেষ্টা করা। 

সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে যে, তারা যেন সন্তানের অর্জনগুলোকে মূল্যায়ন করেন এবং অন্য কারও সঙ্গে বার বার তুলনা করে তার আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে না দেন। এমন বাচ্চারাই বড় হয়ে হয়ত ইমপোস্টার সিনড্রোমের মতো সমস্যায় ভুগবে, জীবন তার জন্য হবে স্বাভাবিকের চেয়েও কঠিন। কেননা তারা নিজের সাফল্যকেও উপভোগ করতে পারে না। 

আগেই বলা হয়েছে, একে ঠিক ডাক্তারিভাবে সারানোর পদ্ধতি নেই। কিন্তু যখন এই সমস্যার সূত্রপাত হয়, তখন যদি ব্যক্তি তা বুঝতে পারে বা তার কাছের মানুষজন সেটি আঁচ করতে পারে– তখন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। যখনই কোনো সাফল্য সম্পর্কে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগবে, সন্দেহ জন্মাবে, তখন তার কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে। যে সাফল্য তার কাছে ধরা দিয়েছে, তার জন্য কি সে যথেষ্ট কায়িক ও মানসিক শ্রম দিয়েছে? সে যে সাফল্য পেয়েছে, সেই সময়ে এই সাফল্যের দাবিদার আর কয়জন ছিল? নিজের দুর্বল দিকগুলোর ওপর জোর দেওয়া বাদ দিয়ে ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। প্রতিদিনের চর্চার মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে আসতে হবে, যাতে অযথা চিন্তায় মাথা ভারি না হয়ে থাকে। অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে জীবনের সাফল্যগুলোকে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার মতোই সাফল্য অর্জনের চেয়েও সাফল্য রক্ষা করা কঠিন। 

Comments

The Daily Star  | English

Reform commission reports: Proposals seek to bring youths into JS

Reform commissions on the constitution and election process have both recommended measures that increase opportunities for the youth to run for parliament and become more involved in politics, sparking both hope and criticism.

8h ago