লতিফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার অগ্রদূতকে স্মরণ

২০১২ সালে অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হওয়ার পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে লতিফুর রহমান। ছবি: কার্টেসি

লতিফুর রহমান—সবার কাছে যিনি শামীম বা শামীম ভাই হিসেবে পরিচিত ছিলেন—মুক্ত ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার অগ্রদূত হবেন, এটা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু যখন এলেন, তখন থেকেই এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অবিচল।

দ্য ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠার আগে তিনি কখনোই এই অতি সংবেদনশীল খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কোনো আগ্রহ দেখাননি। আমার জানামতে, তাকে এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য তারই এককালীন ব্যবসায়িক অংশীদার ও বন্ধু এএস মাহমুদ (যাকে আমি মাহমুদ ভাই বলে ডাকতাম)। মাহমুদ ভাই তাকে এই খাতের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হন।

আমার পরম সৌভাগ্য যে বড় ভাই মাহবুব আনামের কল্যাণে আমি মাহমুদ ভাইয়ের স্নেহের পাত্র হতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমার বড় ভাইয়ের সহকর্মী ছিলেন মাহমুদ ভাই। মাহমুদ ভাই ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে ঢাকা ক্লাবে শামীম ভাইয়ের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। সেই সাক্ষাতে তার মনে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছিলাম কি না, জানি না। তবে এরপর থেকে আমাদের নিয়মিত দেখা হতে থাকে এবং নতুন একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে।

একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবে শামীম ভাই হয়তো ভেবেছিলেন, আমি সত্যিই আমার কর্মস্থল থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে জাতিসংঘের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের অজানা সমুদ্রে তরী ভাসাবো কি না। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে থাইল্যান্ডের রাজধানীতে আমার অ্যাপার্টমেন্টে তার সঙ্গে আমার বৈঠক হয়। ধারণা করি, সেই বৈঠকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন আমার অঙ্গীকার সম্পর্কে।

সেদিনের পর থেকে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে এবং খুব শিগগির আমরা দুজন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এসএম আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে নবজীবন দেওয়ার উদ্যোগে একে অপরের অংশীদার হিসেবে শামিল হই।

দ্য ডেইলি স্টারের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের প্রথম বৈঠকেই নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রতি শামীম ভাইয়ের অকৃত্রিম অঙ্গীকারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্বনামধন্য ও সম্মানিত সাংবাদিক-সম্পাদক আলী ভাই এবং আমি—দুজনই পত্রিকার কার্যক্রম পরিচালনায় শামীম ভাই ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের নির্ধারণ করে দেওয়া নীতিমালা জেনে রোমাঞ্চিত হই।

আমি বা আলী ভাই পরামর্শ দেওয়ার আগেই শামীম ভাই অন্যান্য পরিচালকদের রাজি করিয়েছিলেন যে পরিচালনা পর্ষদের একমাত্র ভূমিকা হবে সার্বিক নীতিমালা তৈরি ও পত্রিকার আর্থিক বিষয়গুলোর দেখভাল করা। তারা যৌথ ঘোষণায় জানিয়েছিলেন, দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিকতার বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে সম্পাদক-প্রকাশকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমাদেরকে উজ্জীবিত করতে এরচেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।

এটা ভাবলে ভুল হবে না যে আলী ভাইয়ের প্রতি সম্মান রেখেই মিডিয়া ওয়ার্ল্ডের পরিচালনা পর্ষদ এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। পত্রিকা প্রতিষ্ঠার আড়াই বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে আলী ভাইয়ের অকালপ্রয়াণের পর আমি সম্পাদক-প্রকাশকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। মিডিয়া ওয়ার্ল্ডের পরিচালনা পর্ষদ আমাকেও একই সম্মান ও স্বাধীনতা দিয়েছে—যা থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছেন।

অন্যদের থেকে শামীম ভাইকে আলাদা করেছে তার এই প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি। দ্য ডেইলি স্টারকে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে হবে এবং সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে হবে—এটাই ছিল পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, দ্য ডেইলি স্টারের এমন একটি পরিচালনা পর্ষদ আছে, যা সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্ণ সম্মান দেয় এবং ব্যবস্থাপকদের কার্যক্রমে স্বাধীনতা দেয়। প্রতিষ্ঠার প্রথমদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

তরুণ লতিফুর রহমান। ছবি: কার্টেসি

মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতি লতিফুর রহমানের অঙ্গীকারের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তার মধ্যে দুটি উদাহরণ তার অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য যথেষ্ট হবে।

সেবার শামীম ভাই এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। একই পদে নির্বাচন করছিলেন ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময়জুড়ে উভয় প্রার্থীর সংবাদ সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে দ্য ডেইলি স্টারে, যদিও শামীম ভাই এই পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমরা দুজনেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছি, দুজনকে নিয়েই লিখেছি—কিন্তু কখনো কারো পাল্লা ভারী করিনি। বিষয়টিকে আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত করেছিলাম যেন প্রতিটি সংবাদে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তথ্য আগে লেখা হয়।

একজন প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিতভাবেই হয়তো চাইতেন যে পত্রিকার পাতায় তিনি যেন বেশি কভারেজ পান। কিন্তু সংবাদপত্রের মালিক হিসেবে তিনি জানতেন, আমরা কীভাবে সংবাদ প্রকাশ করছি সেদিকে নজর রাখছেন পাঠকরা এবং সেই অনুযায়ী তারা আমাদের অবস্থান বিচার করবেন। এই বিষয় নিয়ে তিনি একটি বারও আমাকে কিছু বলেননি। মানের বিষয়ে তার দৃঢ়তা ছিল এতটাই বেশি।

আরেকবার তার সমসাময়িক এক ব্যবসায়ী শামীম ভাইয়ের কাছে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত দুর্নীতি বিষয়ক সংবাদ নিয়ে অভিযোগ জানালেন—স্বেচ্ছায় ঋণ খেলাপি হওয়া এবং সেই অর্থ পাচারের বিষয়ে। শামীম ভাই তাকে পরামর্শ দিলেন এ বিষয়ে সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করার। তিনি তাকে বলে দিলেন, 'আমি পত্রিকা চালাই না, সম্পাদক চালান।' ওই ব্যবসায়ী বিস্মিত হয়ে বললেন, 'আপনি পত্রিকার মালিক, কিন্তু সম্পাদকই সেটা চালাচ্ছেন। এটা কীভাবে সম্ভব?' লতিফুর রহমান এমনই ছিলেন।

যখন মতিউর রহমান (মতি ভাই) ও আমি একটি বাংলা সংবাদপত্র শুরু করার পরামর্শ নিয়ে তার কাছে গেলাম, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হলেন এবং এই পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যোগ্য সম্পাদক হিসেবে মতি ভাইকেই নির্বাচন করলেন।

সাংবাদিকতার যেসব মূল্যবোধের চর্চা নিয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টার শুরু করেছিলেন, তার সব নিয়েই একই উৎসাহ-উদ্দীপনায় তিনি প্রথম আলো চালু করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজি সংবাদপত্র প্রয়োজনীয় হলেও বাংলা পত্রিকার মাধ্যমে মুক্ত গণমাধ্যমের বার্তা আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। তিনি মতি ভাইয়ের বাড়তি উদ্যোগের প্রশংসা করতেন এবং প্রথমা প্রকাশনীর মতো নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নিতে উৎসাহ দিতেন।

তিনি দুই পত্রিকার বার্ষিক স্টাফ ডে উদযাপনে যোগ দিতে কখনো ভুলতেন না—বিশেষত, প্রথম আলোরটা। পত্রিকার অসামান্য অর্জনের প্রশংসা এবং এর জন্য কর্মীদের ও সম্পাদককে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি তিনি সবাইকে আরও বেশি সার্কুলেশন, গুণগত মান ও ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ করতেন। যখন পত্রিকার সার্কুলেশন পাঁচ লাখে পৌঁছে গেল, তখন তিনি বললেন, '১০ লাখের লক্ষ্য কেন নিচ্ছি না?' এমন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। কিন্তু, শামীম ভাই কখনো পিছু হঠতেন না।

প্রথম আলোর ডিজিটাল সংস্করণ যখন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাংলা সংবাদ পোর্টালে পরিণত হলো, তার আনন্দের সীমা ছিল না। তিনি সাধারণত তার আবেগ-অনুভূতি খুব একটা প্রকাশ করতেন না। কিন্তু এই ঘটনার পর তিনি তার উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে পারেননি।

একবার একটি সুপরিচিত টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল ট্রান্সকম। এ বিষয়ে শামীম ভাইকে সহযোগিতা করছিলাম মতি ভাই ও আমি। কয়েক মাসের দরকষাকষির এক পর্যায়ে এসে জানা গেলো, স্যাটেলাইট ফি পরিশোধের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম ছিল না এবং চ্যানেলটি 'অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম' দিয়ে এই ফি পরিশোধ করতো। শামীম ভাই এসবের মধ্যে ছিলেন না। তিনি বলে দিলেন, এ ধরনের চর্চা তিনি কখনোই মেনে নেবেন না। তার নৈতিক দৃঢ়তা আরও একবার আমাদেরকে চমৎকৃত করে এবং আমরাও এ বিষয়ে তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন দেই।

পরিচালনা পর্ষদের প্রতিটি বৈঠকের পর তিনি পত্রিকার নানা বিষয়ে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন। পত্রিকার বিষয়ে কথা বলতে বসলেও তিনি তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের খোঁজখবর নিতে কখনো ভুলতেন না।

লন্ডনভিত্তিক কমার্স চেম্বার ইউকেবিসিসিআইয়ের দেওয়া আজীবন সম্মাননা গ্রহণ করেন লতিফুর রহমান। ছবি: কার্টেসি

একবার প্রথম আলোর একজন ফটোগ্রাফার দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। শামীম ভাই তাকে এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করেন। এর মাধ্যমে তিনি আজীবনের জন্য আমাদের সবার প্রিয়জনে পরিণত হন।

প্রয়াত লতিফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে দ্য ডেইলি স্টারে তার অভাব ভীষণভাবে অনুভব করছি। মুক্ত সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে তার পরশের অভাব অনুভব করছি। অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দুটি সংবাদপত্রের গোড়াপত্তন ও অব্যাহত সাফল্যের ইতিহাসে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

10h ago