শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর আদর্শের নাম লতিফুর রহমান
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের স্মরণে ৫ জুলাই রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় স্মরণসভা ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। যা দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন ও ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে।
আয়োজনে সঞ্চালনায় ছিলেন লতিফুর রহমানের নাতি জারিফ আয়াত হোসেন। আয়োজনে লতিফুর রহমানের স্মৃতিচারণ করেছেন তার বন্ধু, সহকর্মী— যারা দীর্ঘ পথচলায় তার সঙ্গে থেকেছেন, কাছ থেকে তাকে দেখেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান কান্না বিজড়িত কণ্ঠে স্মৃতিচারণের শুরুতেই বলেন, ‘কী বলে শুরু করব। তার সঙ্গে পরিচয় তো সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। এরপর থেকেই এক সঙ্গে কাজ করেছি।’
লতিফুর রহমানের সততা নিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি ব্যবসায় নৈতিকতা ঠিক রাখার ব্যাপারে ছিলেন কঠোর। যে সমাজে আমরা প্রতিদিন আপস করে কাজ করে যাচ্ছি, সেখানে এভাবে সৎ থেকে কাজ করা সত্যিই খুব কঠিন ব্যাপার। এই আপস শব্দটি তার শব্দভাণ্ডারে ছিল না। যত কষ্ট বা সংগ্রামই তার করতে হোক না কেন, তিনি নীতির ব্যাপারে কোনোভাবেই আপস করেননি।’
বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্সে লতিফুর রহমানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। আমৃত্যু তিনি এর সহসভাপতি ছিলেন। আমি বেশ কয়েকবার তাকে বলেছি এর সভাপতি হওয়ার জন্য। কিন্তু, তিনি রাজি হননি।’
‘তার সম্পর্কে বলে শেষ করতে পারব না। তার কর্ম পদ্ধতি, তার সততা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য পাথেও হয়ে রইল’, বলেন মাহবুবুর রহমান।
পেপসিকো এর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের সাবেক সিইও সঞ্জিব চাড্ডা বলেন, ‘শামীম ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তার চলে যাওয়া আমাদের সবার জন্য ক্ষতির। বিশ্বে যত ভালো মানুষ সম্পর্কে জানার সুযোগ আমার হয়েছে, শামীম ভাই তাদের অন্যতম একজন। আরও হাজারো মানুষ আছেন, যারা একই কথা বলবেন।’
‘পেপসিকোর অংশিদারিত্বের কারণে শামীম ভাইয়ের ব্যাপারে জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। যতবারই আমি শামীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছি, প্রত্যেকবারই তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখেছি’, যোগ করেন তিনি।
সবশেষে সঞ্জিব চাড্ডা বলেন, ‘শামীম ভাই সব সময় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন। সব সময় তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন।’
ব্যবসায়িক জগতে লতিফুর রহমানের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘আমাদের এত বছরের সম্পর্ক, এত অল্প সময়ে তার মৃত্যুতে অনুভূতি প্রকাশ করা খুব কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয় নিয়েই তিনি প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। কিন্তু, তিনি তার সমস্যা নিয়ে কখনও কিছু বলেননি। ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈতিক থাকা তার একটি গুণ এবং আমাদের দেশের হিসাবে বিরল একটি গুণ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা ধীরে ধীরে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি। কিন্তু, শামীম একজন ভালো মানুষ ছিলেন।’
‘তিনি কখনও অপ্রয়োজনীয় তর্ক করতেন না। তার প্রতিটি কথায় যুক্তি থাকত’, বলেন তিনি।
ফারাজ আইয়াজ খানের মৃত্যু স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘১ জুলাই তার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন ছিল। কাকতালীয়ভাবে সেই একই দিনে তিনিও চলে গেলেন।’
পারিবারিক জীবনেও লতিফুর রহমান একজন অনুকরণীয় মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে বলতো, তুমি শামীমের কাছে শিখতে পার।’
‘লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে ব্যবসায়িক অঙ্গনে এক শূন্যতা তৈরি হলো। আমি জানি না সেই শূন্যতা কে পূরণ করতে পারবে। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি’, যোগ করেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী।
লতিফুর রহমানের সততার ব্যাপারে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকার সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘আমি এমসিসিআইয়ের সদস্য যখন হলাম, তখন মামা (লতিফুর রহমান) সভাপতি ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কখনোই এমসিসিআইকে নিজের বা সদস্যদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করবে না।’
মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের সবাইকে বলতাম, আমি না থাকলে যে কোনো প্রয়োজনে শামীম আংকেলের কাছে যাবে। আমার নিজের কোনো বিষয়ে পরামর্শ করতে হলে সবার আগে শামীমকে কল করতাম।’
লতিফুর রহমান যেমন পরিবারের প্রতি যত্নবান ছিলেন, তেমনি ব্যবসায়ের প্রতিটি বিষয়ে সতর্ক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি বোর্ড মিটিংয়ে বসেছি। সেখানে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের মানুষ। একবার এক বোর্ড মিটিংয়ে ফাইন্যান্স ডিরেক্টর ভুল হিসাব বিবরণী পেশ করছিলেন। আমরা কেউই সেই ভুল ধরতে পারিনি। কিন্তু, শামীম তা ধরে ফেলেছে।’
‘লতিফুর রহমান ছিলেন আমাদের এক শক্তি। কখনও ভাবিনি তিনি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন’, বলেন রোকিয়া আফজাল রহমান।
লতিফুর রহমানের বন্ধু হাসান আশকারি বলেন, ‘‘সম্ভবত ১৯৬৩ সালে কলকাতায় প্রথম শামীমের সঙ্গে আমার দেখা হয়। যারা আয়োজনে কথা বলছেন বা দেখছেন (তার স্ত্রী ছাড়া), তারা যতদিন ধরে শামীমকে চেনেন, তার থেকেও এটি দীর্ঘ সময়। তখন (১৯৬৩ সাল) থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। তার সম্পর্কে যা স্মরণ করছি, এর বেশিরভাগজুড়েই রয়েছে তার নৈতিকতা, উঁচু মানসিকতা, যা তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত— উভয় জীবনেই ছিল।’
‘আমি কেন শোকাহত? আমি এমন একজন বন্ধুর চলে যাওয়ায় শোকাহত, যে আমার বেঁচে থাকা ও সাফল্য উদযাপন করেছে, যে আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্বের জন্য গর্বিত ছিল, যে কোনোদিন আমার কাছে কিছু চায়নি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে আমাকে স্মরণ করেছিল’, বলেন তিনি।
প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান বলেন, ‘ভাবি শাহনাজ রহমান (লতিফুর রহমানের স্ত্রী), সিমিন হোসেন (মেয়ে), আরশাদ ওয়ালিউর রহমান (ছেলে), জারিফ (নাতি)— সবার কাছে লতিফুর রহমানকে স্মরণে আমি আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাই। আমি মাত্র ২২ বছর ধরে লতিফুর রহমান, আমাদের শামীম ভাইকে চিনি এবং জানি। তার আগে আমি জানতাম-চিনতাম। তবে, তেমন ঘনিষ্ঠভাবে না। আমার জীবনের ২২ বছর, আমি বলতে পারি আমার সারাজীবনের যা অর্জন, তার চেয়ে অনেক বেশি জেনেছি শিখেছি— আমার সম্পর্কে, আমাদের পেশা সম্পর্কে, আমাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে। এবং সব কিছুরই সূত্র আমাদের শামীম ভাই।’
‘আমি প্রথম আলো করতে ট্রান্সকম গ্রুপে যোগ দেই। তার চারটি পরামর্শ ছিল। এক. এক নম্বর কাগজ হতে হবে। দুই. নিজেদের আয়ে চলতে হবে। তিন. সরকারের সকল আইন-কানুন, অর্থাৎ ট্যাক্স-ভ্যাট ঠিকমতো আমাদেরকে দিতে হবে। আর সে জন্য প্রথম আলোকে একটি স্বাধীন-নিরপেক্ষ কাগজ হতে হবে। এবং চার বছরের মাথায় আমাদের প্রথম আলো বাংলাদেশের সেরা কাগজ, এক নম্বর কাগজ এবং নিজেদের আয়ের ওপরে বিগত ২১ বছর ধরে আমরা এই পত্রিকা পরিচালনা করছি’, বলেন তিনি।
মতিউর রহমান বলেন, ‘আরেকটা কথা যেটা মাহফুজ বলেছেন, আমি আবার বলছি, আমাদের মতো এত স্বাধীন সম্পাদক এই বাংলাদেশে কেউ ছিল বলে আমি ভাবতে পারি না। অন্য কোনো দেশে আছে কি না, তাও আমরা জানতে পারি না। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে কোনো সংবাদ, কোনো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, কোনো চাকরির নিয়োগ বা বাতিল করা বা যে কোনো সিদ্ধান্ত এক শ ভাগ, বলতে পারি ৯৯ ভাগ, বলতে পারি এক শ ভাগ, এটা আমরা নিজেরাই দেখি। এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তার কাছ থেকে। সকল বিষয়ে তিনি আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন।’
আরও পড়ুন:
‘গণমাধ্যম হারাল স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি শক্ত ভিত্তি’
Comments