শ্রদ্ধাঞ্জলি

লতিফুর রহমান: স্বাধীন সাংবাদিকতা সংগ্রামী

Latifur Rahman
লতিফুর রহমান। ছবি: স্টার

লতিফুর রহমান, আমাদের প্রিয় শামীম ভাই, আর আমাদের মাঝে নেই— এই সত্যকে আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি। অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে খুব বেশি সম্পৃক্ত মনে হতো। কী ঘটতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। যে পরিকল্পনাগুলো করছিলেন সে বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থেকে বিশ্বব্যাপী ধেয়ে আসা পরিবর্তনগুলোর প্রভাব সম্পর্কে ভীষণ সচেতন ছিলেন।

তিনি বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে খুবই গর্বিত ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, 'বাংলাদেশ যত এগিয়ে যাচ্ছে, এর অর্থনীতিও তত বড় ও শক্তিশালী হচ্ছে। দ্য ডেইলি স্টারের ভবিষ্যতও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে। তোমাকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে যে সবচেয়ে বড় ও বিশ্বস্ত সংবাদপত্র হিসেবে তোমার অবস্থান ধরে রেখেছ। দেশে সব সময়ই মানসম্মত একটি ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রের দরকার। সুতরাং তুমি যদি গুণগত মান বজায় রেখে কাগজের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারো, তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত।' তার এই বিশ্বাস আমাদের সবাইকে উৎসাহিত করেছে, বিশেষ করে আমার কর্মোদ্যম দ্বিগুণ হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি অটুট বিশ্বাস এবং দেশের প্রতি সর্বোচ্চ অঙ্গীকার ছিল আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক লতিফুর রহমানের পরিচয়ের নির্দেশক। তিনি গর্বিত ছিলেন এই জন্য যে, বিদেশে কখনো এক টাকাও বিনিয়োগ করেননি এবং জীবনে যা করেছেন তা শুধু বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের জন্য।

তিনি বহুবার বলেছেন, তার ছেলে-মেয়েরা বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করেছেন, কিন্তু কেউ সেখানে থেকে যাননি কিংবা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। তার নাতি-নাতনিদের, যারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করতেন তাদের কথা উল্লেখ করে বলতেন, 'আমি নিশ্চিত যে তারা সবাই দেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করবে।'

তার ধারণাই ছিল না যে প্রিয় নাতি ফারাজ এমন অনন্য সাধারণ কিন্তু মর্মান্তিকভাবে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে, সাহসের সঙ্গে হত্যাকারীদের পাশবিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে তার (লতিফুর রহমান) ও তার পরিবার এবং দেশের মানুষের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। এক জঘন্যতম সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে নাতি হারানোর বেদনা সহ্য করা নানা হিসেবে তার জন্য খুব কঠিন ছিল। তারপরও ফারাজের ভূমিকার কারণে তার অপরিসীম গর্ব ছিল।

এই শোকে তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হতে থাকলেও বাইরে থেকে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি আমাদের অধিকাংশের কাছেই অদম্য বলে মনে হয়েছিল। এভাবেই তিনি নিজের ক্ষতকে গর্ব হিসেবে দেখেছেন। কাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও পরিবারের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। শুধু পরিবারের জন্যই নয়, তার সঙ্গে কাজ করা প্রত্যেকের জন্য সাহস ও শক্তির আধার হতে হয়েছে তাকে। এর জন্য তাকে মানসিকভাবে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে।

তার সম্পর্কে যত বেশি চিন্তা করি ততই বুঝতে পারি, এই সংবাদপত্রের বিষয়ে তার অবদান কতটা মৌলিক ছিল। যে দেশে পারিবারিক মালিকানায় সংবাদপত্রের প্রকাশ এবং সংবাদপত্রকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার ঐতিহ্য রয়েছে, সেখানে দ্য ডেইলি স্টারই প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে করপোরেট সংস্কৃতি চালু করে। এ দেশে সংবাদপত্র জগতে পরিচালনা পর্ষদের অস্তিত্ব অপরিচিত ছিল এবং যেটুকু ছিল তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

শুরুর দিকে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার আজিমুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কার্যকরী পরিষদ ছিল—যেটি অর্থনৈতিক বিষয়ে কঠোর এবং সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপমুক্ত। এই পত্রিকার গত ২৯ বছরে (আমার সম্পাদনার সময়কাল) আমার কোনো সম্পাদকীয় অবস্থানের বিষয়ে কখনোই কোনো ফোন কল পাইনি বা বোর্ড মিটিংয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হইনি। এমনকি সেটা সংবেদনশীল বা রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচরণ হলেও। এটি ছিল দ্য ডেইলি স্টারের সেই বোর্ড, যেখানে লতিফুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়, প্রাণবন্ত, বিচক্ষণ ও পথপ্রদর্শক।

সংবাদপত্রটি একবার সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শক্তিশালী সম্পাদকীয় অবস্থান না নেওয়ার কারণে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিযোগ করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'আমি সম্পাদককে পুরোপুরি বিশ্বাস করি। সময়মতো তিনি যথোপযুক্ত অবস্থান নেবেন।'

পরে দ্য ডেইলি স্টার সেই কাজটি করার পর লতিফুর রহমান তার বন্ধুকে ডেকে আগের কথাগুলো মনে করিয়ে দেন। এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বন্ধু বিষয়টি আমাকে জানান। তিনি এবং পুরো বোর্ড এতটাই সম্মান, আস্থা ও মর্যাদার সঙ্গে সম্পাদকের সঙ্গে আচরণ করেন।

আমার দৃষ্টিতে লতিফুর রহমান ছিলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে সবচেয়ে প্রবল ও সক্রিয় সমর্থক। আজীবন ব্যবসায়ী হলেও সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা', 'ভিন্নমত' এবং 'স্বাধীন সাংবাদিকতা'র মূল্য সম্পর্কে তার স্বজ্ঞাত ধারণা ছিল।

তার মতে, একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের কেন্দ্রে রয়েছে 'বিতর্ক'। তিনি চাইতেন, দ্য ডেইলি স্টার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সব ধরনের চিন্তা ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে 'বিতর্কের' প্ল্যাটফর্ম হবে। তিনি বলতেন, নীতিমালার গভীর বিশ্লেষণ ও সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা সংবাদপত্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব।

তিনি সব সময়ই দৃঢ়ভাবে একটি ধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন, সেটি হলো সামরিক একনায়কত্ব বা সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তানের দুর্দশার জন্য দেশটির সামরিক বাহিনীর ভূমিকা এককভাবে দায়ী এবং তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটানো উচিত হবে না।

লতিফুর রহমানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে দ্য ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের জন্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে আপসহীন অবস্থান ও ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক সরকারই এ দেশের জন্য সেরা সরকার বলে দৃঢ় প্রত্যয়ের জন্য আমরা তাকে স্মরণ করি। সর্বোপরি বাংলাদেশের প্রতি তার বিশ্বাস এবং দেশের সমৃদ্ধিতে তার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের জন্য আমরা তাকে স্মরণ করি।

তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন দেশপ্রেমের উদাহরণ।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

9h ago