লতিফুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: স্বাধীন সাংবাদিকতায় তার উপহার
একজন সম্পাদক একটি পত্রিকা পরিচালনা ও গড়ে তোলার জন্যে যেমন উদ্যোক্তার স্বপ্ন দেখেন বা প্রত্যাশা করেন, তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আরও অনেক বেশি কিছু হয়ে উঠেছিলেন। সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে মতিউর রহমান ও আমি যথাক্রমে দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা সম্পাদনা করি। এর সবই সম্ভব হয়েছে তার নীতি, সততা, সাহস, অবিচলতা ও স্বাধীন মিডিয়ার প্রতি অদম্য বিশ্বাসের কারণে। তিনি জানতেন এগুলো না থাকলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে পারে না।
এরশাদের পতনের পর পুরো জাতির মতো তিনিও একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। একটি স্বাধীন পত্রিকা শুরু করার জন্য আরও কয়েকজন দূরদর্শী উদ্যোক্তা এবং দুই জন সাংবাদিককে (এসএম আলী এবং আমাকে) নিয়ে একটি টিম গঠন প্রক্রিয়ায় যোগ দেন। পরবর্তীতে যে টিমের চালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন তিনি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও সমর্থন এবং কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তিনি দুটি স্বাধীন সংবাদপত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন। যা বাংলাদেশের জন্য তার উপহার হিসেবেই আমি মনে করি।
তিনি এবং পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা সম্পূর্ণ সম্পাদকীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী থেকেছেন সূচনাকাল থেকেই। দ্য ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় ২৯ বছর এবং প্রথম আলোর প্রায় ২১ বছর (প্রথম ১০ বছর আমি এর প্রকাশক ছিলাম)। এই দীর্ঘ সময়ে কী প্রকাশ করা উচিত বা কী করা উচিত নয় কিংবা কোন সংবাদটি কীভাবে করা উচিত, সেই বিষয়ে তিনি আমাদের কোনো পরামর্শ, উপদেশ, এমনকি ইঙ্গিতও দেননি। দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর অন্যান্য পাঠকের মতোই তিনিও সকালে উঠে সংবাদপত্রগুলো পড়তেন। দীর্ঘ পথচলার এই সময়কালে তিনি আমাদের প্রকাশিত কোনো খবরের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেই পারতেন। হয়তো তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছেনও। কিন্তু, তিনি তার মত কখনো আমাদের ওপর চাপিয়ে দেননি।
এমনকি এই দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে অনেক সময়ই তিনি ক্ষমতাসীনদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। কিন্তু, সেই ক্ষোভের প্রভাব কখনই তিনি আমাদের দৈনন্দিন কাজের ওপর পড়তে দিতেন না। প্রকৃতপক্ষে, তিনি আমাদের কখনো এটাও বলেননি যে আমাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় নীতি বা প্রকাশিত মতামতের কারণে তিনি কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি করতে পারেননি কিংবা কারখানা তৈরির অনুমোদন পেতে দেরি হয়েছে বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কিংবা তার ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। দুটি সংবাদপত্রের পেছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তিনি আর কিছুই বলেননি।
আমার সম্পাদনার প্রথম বছরের একটি ঘটনা এই বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক লতিফুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দ্য ডেইলি স্টার কেন বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আপনি সম্পাদকের সঙ্গে কেন কথা বলছেন না, পত্রিকাটি তিনি চালান।’ এমন উত্তর শুনে অবিশ্বাস নিয়েই ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আপনি পত্রিকায় বিনিয়োগ করেছেন আর সেটি চালাচ্ছেন সম্পাদক! তা কীভাবে হয়?’ সত্যিই এভাবেই পত্রিকাটি পাড়ি দিয়েছে এই সুদীর্ঘ পথ। আর সেই কারণেই আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।
তার ভেতরে আরেকটি মৌলিক বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে ছিল। তা হলো— বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজন। গণতন্ত্র এবং মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম একে অপরের পরিপূরক। এটিই ছিল তার জীবনের দর্শন। যা পরবর্তীকালে তার জীবনের আসক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সেই আসক্তির একটি অংশ হতে পারা আমার জন্য সম্মানের বিষয়।
তিনি নিতান্তই একজন মার্জিত ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তার শিষ্টাচার ও নিখুঁত সৌজন্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যে কোনো জায়গায় উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তিনি কারো সঙ্গে আলোচনার সময় বিতর্কিত বিষয় আনতেন না। তবে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে সত্য বলতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তিনি দৃঢ় বিশ্বাসের মানুষ ছিলেন। তবে, সত্য ও যথাযথ যুক্তি দিয়ে বোঝানো গেলে তিনি তা মেনে নিতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু, যারা তাকে চ্যালেঞ্জ করতেন, তারা সহজেই বুঝতে পারতেন যে তিনি যা বিশ্বাস করেন তার স্বপক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য ও যুক্তি তার কাছে আছে।
তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটি লুকায়িত রসবোধ ছিল। তার এই গুণটি খুব সহজে প্রকাশ পেত না। তবে, একবার তা প্রকাশ পেলে তার হৃদয়গ্রাহী হাসি যে কোনো আয়োজনকে করে তুলত আলোকিত। সেখানে উপস্থিত সকলের জন্যই তা হয়ে থাকতো অবিস্মরণীয়।
তার ব্যক্তিত্বের আরেকটি অনন্য দিক ছিল আত্মমর্যাদাবোধ। তিনি কখনো তার আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন রুচিশীল মানবিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হতেন না। এমনকি মেয়ে এবং নাতিকে হারানোর মতো অপূরণীয় শূন্যতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি তা বজায় রেখেছেন। ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হয়েছেন। তা দৃশ্যমান করেননি। শূন্যতার সবটুকু নিজে ধারণ করেছেন। যা আমাদের বেশিরভাগের কাছে অতিমানবীয় মনে হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে তিনি এমন দিনে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন, চার বছর আগের যে দিনে তার নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন ঢাকায় সন্ত্রাসীদের কাপুরুষোচিত আচরণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তিনি ব্যবসার জগতে পুরোটা জীবন কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি ছিলেন একজন আইকনিক মানুষ হিসেবে। সবার কাছেই সমান শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। তার বিস্ময়কর সততা ও ব্যবসায়িক নৈতিকতা ছিল একেবারে কিংবদন্তিতুল্য। তিনি অনেক ব্যবসার সুযোগ ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কারণ সেগুলো শতভাগ নৈতিক ছিল না। সততার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং ব্যবসায় সর্বোচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখায় তিনি সম্মানিত হয়েছেন সর্বক্ষেত্রে।
তার অকাল মৃত্যুতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত—উভয় দিক থেকেই আমার যে ক্ষতি হলো, তা অবর্ণনীয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন বন্ধু, একজন ভাই, একজন পরামর্শদাতা, নিরুপায়বোধ করলে শক্তির উৎস। কোনো বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে বা সুনির্দিষ্ট বিকল্প না থাকলে একজন উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন সারাজীবন। একে একে আমি যখন আমার চার ভাইকে হারিয়েছি, তখন তিনি একজন ভাই হয়েই আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভাই হারানোয় যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, তা পূরণে তিনি সবসময় আমার পাশে ছিলেন। পাহাড়সম বাধা যখন আমার সামনে এসে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াত, তখন তিনি আমার পক্ষে থাকতেন সাহসের ঝরনা হয়ে।
আমি প্রায়শই তাকে দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম, মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত না থাকা একজন ব্যবসায়ীর কীভাবে একটি মুক্ত গণমাধ্যমের গুণাবলীর প্রতি এত দৃঢ়, গভীর ও অটল বিশ্বাস থাকতে পারে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি তার যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি, সেটি বাংলাদেশে স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটি স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় অংশীদার হিসেবে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত তা বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছিল। যেখানে ছিল পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধার আত্মিক বন্ধন।
যে মানুষটির কাছে আমি চিরঋণে আবদ্ধ, হৃদয়ে এক অবিশ্বাস্য শূন্যতা নিয়ে তার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments