ব্যাংক একীভূতকরণ স্বেচ্ছায় নাকি জোর করে
সম্প্রতি বাংলাদেশের দুর্বল পাঁচটি ব্যাংককে ভালো পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে।
কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় একীভূত হচ্ছে। কিন্তু একীভূতকরণের খবরগুলো যাচাই করলেই বোঝা যায়, স্বেচ্ছায় নয় বরং এসব ব্যাংককে একীভূত হতে বাধ্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণে গত ৪ এপ্রিল বিস্তৃত গাইডলাইন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে দুইভাবে একীভূতকরণের কথা উল্লেখ করা হয়- প্রথমে স্বেচ্ছায় এবং পরে বাধ্য করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের উপযুক্ত ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করবে এবং আগামী বছরের মার্চ থেকে প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু করবে।
নীতিমালা জারির আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে পৃথক বৈঠক হয়, পরে তিনটি একীভূতকরণের পরিকল্পনার কথা জানা যায়। এরপর বাকি দুটি একীভূতকরণের কথা জানা যায়।
গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রথম 'স্বেচ্ছায়' একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, সরকার 'প্রস্তাব' দিয়েছে বলেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এরপর সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ৩ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মধ্যে একক বৈঠকের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত আসে।
তবে, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মানববন্ধন করে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।
এরপর সিদ্ধান্ত হয়েছিল সংকটে ভুগতে থাকা বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংককে যথাক্রমে সিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে একীভূত করা হবে।
এজন্য গত ৮ ও ৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সিটি ব্যাংক ও ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের মধ্যে দুটি পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ওই বৈঠকে বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন না।
এতেই বোঝা যায়, এসব সিদ্ধান্তে বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মত নেই অর্থাৎ এগুলো স্বেচ্ছায় একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নয়।
বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত ১৮ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানায়, তারা বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের পরিবর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা এখনো একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন এবং তাদের সম্মতি ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুল আলম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একীভূতকরণের খবর প্রচার হলে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে ভিড় করতে শুরু করেছে, এতে সংকটে থাকা ব্যাংকটি আরও চাপে পড়েছে।'
ইউসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জেনেছে। তারা ন্যাশনাল ব্যাংকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পাঠায়নি কিংবা ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে কোনো প্রস্তাব পায়নি।
ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরী বলেন, 'আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং ব্যাংক আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব পাঠায়নি।'
এসবের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক জানায় জোর করে মার্জার বা ফোর্স মার্জার ভালো ফল আনে না। বিশ্বব্যাংকের মতে, জোরপূর্বক একীভূতকরণ কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।
বিশ্বব্যাংক বলছে, আগে থেকে সম্পদের গুণগত মানের যথাযথ মূল্যায়ন করা না হলে জোরপূর্বক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে।
'একীভূত করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অধিগ্রহণকারী ভালো ব্যাংকের দুর্বল হওয়া এড়াতে সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।'
চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মান মূল্যায়ন করতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করা। প্রয়োজনে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা নিতে পারে।'
এখন প্রশ্ন হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ কী হতে পারতো?
যেহেতু একীভূতকরণের ব্যাপারে তাদের কোনো ব্যবহারিক জ্ঞান নেই, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে শুরু করতে পারতো। তারা একসঙ্গে একাধিক একীভূতকরণের পরিবর্তে বেছে বেছে পর্যায়ক্রমে একীভূতকরণ করতে পারতো।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আগামী ডিসেম্বরের পরে বাধ্যতামূলক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিতো পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক অনুয়ায়ী তাহলে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সমালোচনা এড়াতে পারতো।
Comments