ধুঁকতে থাকা ব্যাংকিং খাতে কতটা স্বস্তি ফেরাবে একীভূতকরণ?

বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বাংলাদেশের কোটিপতি,

শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক দুর্বল পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য একটি চমক হিসেবে দেখছেন অনেকে।

আর্থিক খাতে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত কৌশল। তবে, বাংলাদেশে বিষয়টি একেবারে নতুন না হলেও দু'একটি ঘটনা ছাড়া অতীতে খুব একটা নজির দেখা যায়নি।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বিশেষ করে বলতে গেলে, ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম চলছে। ফলে এই খাতটি প্রায় ডুবতে বসেছে। তাই দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তারই উদ্যোগ হলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে আছে- প্রভাবশালী মহলের চাপ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ অনুমোদন, ভুয়া কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া এবং পরিচালকদের নিয়ম বহির্ভূত আধিপত্য বিস্তার। এসব অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সুশাসনের অভাব ও ব্যাপক ঋণ অনিয়মের কারণে ১০ থেকে ২০টি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে, ব্যাংকিং খাতের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা কমে গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যাংকের অবস্থা ভালো, বাকি ১০ শতাংশ দুর্বল।

ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কৌশলের অংশ হিসেবে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার কথা জানানো হয়। সেই প্রক্রিয়ার প্রথম ব্যাংক হতে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।

তবে, এভাবে একীভূত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা সহজ কাজ হবে না। কারণ এই কৌশলের সাফল্য অনেক সময় কোন ধরনের ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে।

উদাহরণ হিসেবে এখানে বলা যেতে পারে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন করে। অথচ দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিডিবিএল এখনো খেলাপি ঋণে ধুঁকছে।

ডিসেম্বরে বিডিবিএলের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

আবার সফলতার উদাহরণও আছে।

যেমন- ২০০০ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক স্ট্যানচার্ট গ্রিন্ডলেজ গঠনে এক হয়, পরে নামকরণ করা হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ। বর্তমানে বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক একটি উদ্যোগ।

২০০১ সালে ব্যাংক অব নোভা স্কটিয়ার ব্যবসায়িক কার্যক্রম অধিগ্রহণ করে ব্যাংক এশিয়া, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ ছিল এটি। ব্যাংকটি মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের কান্ট্রি অপারেশনও গ্রহণ করে। বর্তমানে ব্যাংক এশিয়া দেশের অন্যতম সফল ব্যাংক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে দুটি দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণ খারাপ নজির স্থাপন করতে পারে। কারণ এ ধরনের উদ্যোগ অন্যদের ঋণ অনিয়মে উৎসাহিত করবে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে বেইলআউট সুবিধা নেবে।

ব্যাংকগুলোর অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা ব্যাংক রেড জোনে আছে এবং এক্সিম ব্যাংক ইয়েলো জোনে ছিল। অর্থাৎ উভয় ব্যাংকই দুর্বল।

দুটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে ভালো ব্যাংক গঠন করা কঠিন হয়ে পড়বে, যেমনটা বিডিবিএলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূতকরণে দুর্বল ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ সরকারের একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কিনে নেবে। যদি তাই হয়, তাহলে তা হবে রুগ্ন ব্যাংকের জন্য সরকারের তরফ থেকে বেইলআউট প্যাকেজ।

ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের কাছ থেকে রেগুলেটরি সুবিধা পেয়েছে পদ্মা ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক ৭১৫ কোটি টাকায় ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিল। কিন্তু নিজের মতো করে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের আগে একটি সমন্বিত নিরীক্ষা খুবই দরকারি।

তিনি বলেন, নিরীক্ষায় যদি দেখা যায়- এক্সিম ব্যাংকের স্বাস্থ্য দুর্বল, তাহলে পদ্মা ব্যাংককে এর সঙ্গে একীভূত করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রণোদনা বা সহনশীলতার কারণে কিছু ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের আওতায় আসতে চাইবে, তবে তা হবে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

একই কথা বলেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান।

তিনি বলেন, 'একীভূত করার মাধ্যমে সুশাসন ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে, কারণ নতুন প্রতিষ্ঠানে বিরোধ দেখা দিতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English
Yunus welcomes UN report on July uprising

‘Otherwise, people will not forgive us’

In an interview in Dubai, Chief Adviser Prof Yunus vows to bring Hasina regime leaders to justice

10h ago