ফিলিস্তিনের শিশু: এত জন্ম, তবু কমে আসে জাতির আকার
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/gaza_1.jpg)
ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য যে 'ঘুমপাড়ানি গান' লিখেছিলেন উর্দু ভাষার কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, সেখানে মায়ের কোলে শুয়ে থাকা বাচ্চার কপালে চুমু দেওয়ার জন্য চাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কারণ চাঁদ ব্যস্ত ছিল ওই মৃত্যু উপত্যকার বাসিন্দাদের সমাহিত করার কাজে।
তাই সেখানকার বেঁচে থাকা শিশুদের সান্ত্বনা দিতে ফয়েজকে বলতে শোনা যায়, 'না বাছা, কেঁদো না!/তোমার বাসভূমে/মৃতদের গোসল দিয়েছে সূর্য/চাঁদ দিয়েছে কবর।'
এরও অনেক আগে ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশ লিখে যান, 'আজকের দিনটি আগামী দিনের থেকে হয়তো ভালো,/কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন/প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা/তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে।/তাদের গণনা করা মূল্যহীন।'
গত সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলিদের বন্দুক-বোমার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে এই শিশুরা। এই সাত দশকে সাতটি প্রজন্মের এমন হাজারো শিশু ঝরে গেছে। কিন্তু গাজাবাসী জানে তারা নিজে মরলেও জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই ধ্বংসপ্রায় ফিলিস্তিনি জাতিকে টেকাতে, অজস্র মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহীদদের শূন্যস্থান ভরাটের জন্য আরও আরও সন্তানের জন্ম দিয়ে চলে তারা। তাতেও সংকুচিত হয়ে আসে বংশগতির ধারা।
এখানেও প্রাসঙ্গিক মাহমুদ দারবিশ। তার বিখ্যাত 'পরিচয়পত্র' কবিতায় পাওয়া যায়, 'লিখে রাখো!/আমি একজন আরব/এবং আমার পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার/আমার আটটি সন্তান/আর নবমটি পৃথিবীতে আসবে গ্রীষ্মকালের পর/তোমরা কি ক্ষুব্ধ হবে তাতে?'
৭ অক্টোবর ইসরায়েল ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে গাজায় তীব্র বোমা বর্ষণ করে চলেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে তিন হাজারে পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নিহতদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/gaza.jpg)
মানবাধিকার সংগঠন ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল ফিলিস্তিনের (ডিসিআইপি) হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর অব্যাহত হামলায় গাজা উপত্যকায় গড়ে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
গাজায় ডিসিআইপির সিনিয়র ফিল্ড রিসার্চার মোহাম্মদ আবু রুকবেহ'র ভাষ্য, গাজার শিশুদের ওপর এই হামলার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হবে বিপর্যয়কর।
এই মুহূর্তে গাজার আল শিফা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ঘাসান আবু সিত্তাহও বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আহতদের ৪০ শতাংশই ছিল শিশু।
পরিবারের সব সদস্যকে হারানো এমন কিছু শিশুর কথা জানাতে গিয়ে এই চিকিৎসক আবেগঘন এক পোস্টে লেখেন, 'যে শিশুটিকে দেখাশোনা করার জন্য কেউ থাকল না, তার জন্য এই মহাবিশ্বে হাসপাতালের বিছানার মতো এমন নিঃসঙ্গ জায়গা আর নেই।'
গাজা উপত্যকায় শিশুদের বয়স পরিমাপ করা হয় তারা কতগুলো ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের কম এবং বর্তমান আক্রমণটি গত ১৫ বছরের মধ্যে ইসরায়েলের পঞ্চম ও সবচেয়ে বড় আক্রমণ।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/394198873_309675291794581_5406890963144803676_n.jpg)
সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গাজায় প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে চার শিশু বিষণ্নতা ও ভয়ের মধ্যে বাস করছে। এখানকার অর্ধেকেরও বেশি শিশু আত্মহত্যার কথা ভাবে এবং অন্য শিশুদের মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলায় শত শত নারী ও শিশুর প্রাণহানির ঘটনায় গত ১৪ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় ইউনিসেফ।
এদিকে মঙ্গলবার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত কয়েকদিনে গাজার বেশ কয়েকটি পানি শোধনাগার বন্ধ হয়ে গেছে। এদিন দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দারা মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য পানি পেয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিন কার্যালয়ের পরিচালক জেসন লি'র ভাষ্য, 'পানির প্রবাহ ও গাজার শিশুদের জীবন এখন একই সূত্রে গাঁথা। যুদ্ধের অবসান বা যুদ্ধবিরতি না হলে হাজারো শিশুর প্রাণহানি হবে।'
২৩ বছরে ২৩০১ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত
ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইনের (ডিসিআইপি) হিসাব অনুসারে, ২০০০ সাল থেকে চলতি আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত ফিলিস্তিনি শিশুর সংখ্যা দুই হাজার ৩০১।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে ২০১৪ সালে। অধিকৃত পশ্চিম তীরে তিন ইসরায়েলি কিশোরকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে সে বছর ৮ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ৫০ দিন গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালায় ইসরায়েলি বাহিনী।
'অপারেশন প্রোটেকটিভ এইজ' নামে পরিচিত ওই অভিযানে দুই হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৫১ জনই ছিল শিশু। নারী ছিলেন ২৯৯ জন।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/393864620_2077367695936926_51188812337754785_n.jpg)
মৃত্যু উপত্যকায় জন্মের অপেক্ষায় ৫০ হাজার শিশু
ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণের মধ্যেই গত মঙ্গলবার রাতে মধ্য গাজার আল–আহলি আরব নামের হাসপাতালে এক নজিরবিহীন হামলায় অন্তত ৫০০ ব্যক্তি নিহত হন। এর আগে ইসরায়েলি হামলায় আহত শত শত রোগী ও গৃহহীন অসংখ্য বাসিন্দা 'নিরাপদ' ভেবে ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এই হামলার পর জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অফিসের মুখপাত্র সেলিম ওয়েইস বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, 'গাজার কোনো জায়গাই এখন শিশু ও তার পরিবারের জন্য নিরাপদ নয়।'
হাসপাতালে হামলার ওই ঘটনাকে 'ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য' অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানান তিনি।
এমন পরিস্থিতিতেও বোমা-বারুদে মাটিতে মিশে যেতে থাকা এই উপত্যকায় অন্তত ৫০ হাজার নারী সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। সংস্থাটির হিসাব অনুসারে, এখন গাজায় প্রতিদিন অন্তত ১৬০ জন নারী সন্তান প্রসব করছেন।
বিশেষজ্ঞরা ও মানবিক সংস্থাগুলোর ভাষ্য, গাজায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানি ফুরিয়ে আসায় এখানকার পরিবেশ অন্তঃসত্ত্বা নারী, নতুন মা ও শিশুদের জন্য আরও বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।
উদ্দেশ্য 'প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়া'
ডিসিআইপির হিসাবে ২০১৮ সালে ৫৬ ফিলিস্তিনি শিশু ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হয়। কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে সংগঠনটি জানায়, টার্গেট হওয়া শিশুগুলো ছিল নিরস্ত্র। তারা ইসরায়েল বা এর নাগরিকদের জন্য কোনো ধরনের হুমকিও তৈরি করেনি। এদের মধ্যে পাঁচ শিশুর বয়স ছিল ১২ বছরের নিচে।
তখন এ সংক্রান্ত এক নিবন্ধে লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম-পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট মনিটরের রামোনা ওয়াদি লেখেন, 'ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা বা জখম করার মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে, যারা উপনিবেশবিরোধী লড়াই চালু রাখতে পারে।'
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/shoes.jpg)
এক জোড়া রক্তাক্ত জুতার ছবি ও ফিলিস্তিনি নারীর কার্টুন
এ দফায় গাজায় নির্বিচার ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর হাসপাতালের বিছানায় রাখা কোনো এক শিশুর একজোড়া রক্তাক্ত জুতা ও মোজার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
মিশরে বসবাসরত মুহাম্মদ এম আলসাখি নামের এক ব্যক্তি ওই ছবিটি শেয়ার করে লিখেছেন, 'হে বিশ্ব! তুমি তখনই এ বিষয়টি অনুভব করতে পারবে, যখন এই জুতাজোড়া তোমার সন্তানের হবে।'
ছবির এই জুতাজোড়া মনে করিয়ে দেয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক বাক্যের একটি গল্প—'বিক্রি হবে: কখনো না পরানো এক জোড়া পুরোনো জুতা।'
একইসঙ্গে মনে পড়ে আট বছর আগে যুদ্ধের তাড়া খেয়ে তুরস্কের উপকূলে ভেসে ওঠা সিরীয় শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির মুখ। আর জুতা জোড়াকে মনে হয় বিপন্ন শৈশব, বিপন্ন মানবতার চিহ্ন।
পাশাপাশি কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া একটি কার্টুনও অনেকের নজর কেড়েছে। সেখানে একজন ফিলিস্তিনি নারীকে দুইভাবে আঁকা হয়েছে। এক পাশে দেখা যাচ্ছে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আরেক পাশে সেই মা অশ্রুসজল চোখে বহন করছেন তার শিশুসন্তানের মরদেহ। রক্তাক্ত শিশুটির দেহে জড়ানো ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যবাহী রুমাল ও লাল-সবুজ পতাকা।
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/10/19/palestine_mother.jpg)
কার্টুনটি এঁকেছেন আলা আল লাগতা নামে এক কার্টুনিস্ট। নিচে আরবিতে যে ক্যাপশন লিখেছেন, তার ইংরেজি করা হয়েছে এভাবে—ইন প্যালেস্টাইন, দ্য মাদার ক্যারিজ হার সন টুয়াইজ!
এর অর্থ হলো, একজন ফিলিস্তিনি মা তার ছেলেকে দুইবার বহন করেন। একবার গর্ভধারণের সময়। আরেকবার মৃত্যুর সময়।
এখানেও শরণ নেওয়া যেতে পারে মাহমুদ দারবিশের। তিনি লেখেন, 'মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু তাই বলে/জীবনকে তো থামিয়ে রাখা যায় না।'
তাই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ছাদখোলা কারাগারে জীবন-মৃত্যুর অঙ্ক কষতে থাকা ফিলিস্তিনিরা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মরণ অবধারিত জেনেও গুলতি কিংবা পাথর হাতে সটান দাঁড়িয়ে যান ভয়াল ট্যাঙ্কের সামনে। বোমা-বারুদ আর মৃত্যুর আবহে চলে প্রেম-মমতা আর বংশগতির বিস্তারও। এত রক্তপাত, এত প্রাণনাশের পরও।
Comments