সিএনএনের বিশ্লেষণ: যেভাবে অস্ত্রের যোগান পায় হামাস

প্রায় ১৭ বছর ধরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে গাজা। এ ছাড়া আকাশ ও নৌপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল এবং অঞ্চলটি সার্বক্ষণিক নজরদারিতেও রয়েছে। তা সত্ত্বেও হামাসের হামলায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ব্যবহারে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যেভাবে অস্ত্রের যোগান পায় হামাস
হামাসের আল কাশেম ব্রিগেডের যোদ্ধাদের হাতে মর্টার ও কালাশনিকভ রাইফেল। ফাইল ছবি: এএফপি

ইসরায়েলে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছে হামাস। এ হামলায় কয়েক হাজার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, বিস্ফোরক, ছোট ও হালকা অস্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে হামাস। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, হামাসের এসব অস্ত্রের উৎস কী?

গতকাল বুধবার সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।

হামাসের হামলায় হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও শতাধিক সামরিক-বেসামরিক মানুষকে জিম্মি করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় লাগাতার বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল

ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ৩৬০ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ গাজা উপত্যকা থেকেই মূলত এই হামলা চালানো হয়। গাজার দুই পাশে ইসরায়েল ও অপর পাশে মিশরের সীমান্ত।

এই দরিদ্র অঞ্চলে প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস হলেও এখানে তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে।

প্রায় ১৭ বছর ধরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে গাজা। এ ছাড়া আকাশ ও নৌপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল এবং অঞ্চলটি সার্বক্ষণিক নজরদারিতেও রয়েছে। তা সত্ত্বেও হামাসের হামলায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ব্যবহারে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও উপকারী বিদেশি বন্ধুর সহায়তায় এটি সম্ভব হয়েছে।

ইরানের ভূমিকা

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, 'হামাস স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে ও বাইরে থেকে অস্ত্র নিয়ে আসে। তারা ইরানের কাছ থেকেও কিছু সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকে।'

তবে সাম্প্রতিক সময়ের এই হামলার সঙ্গে ইরানের সরাসরি সংযোগ থাকার কোনো প্রমাণ এখনো পায়নি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ইরানও এ ধরনের দাবি অস্বীকার করেছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান দীর্ঘদিন ধরেই হামাসের মূল সামরিক সহায়তাদানকারী দেশ। ইরান থেকে আন্তসীমান্ত গোপন সুড়ঙ্গ ও ভূমধ্যসাগরের অবরোধ এড়িয়ে যেতে সক্ষম নৌযানের মাধ্যমে অস্ত্র নিয়ে আসে বলে তারা জানান।

সুড়ঙ্গ ও নৌপথে অস্ত্র আনা

সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসে হামাস।  ফাইল ছবি: এএফপি
সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসে হামাস। ফাইল ছবি: এএফপি

হামাসের অনেক বড় আকারের গোপন সুড়ঙ্গ অবকাঠামো রয়েছে। ইসরায়েল ও মিসর নিয়মিত এই সুড়ঙ্গপথ ধ্বংসের চেষ্টা চালালেও এখনো এর বেশিরভাগ অংশ অক্ষত রয়েছে বলে জানান একজন ওয়াশিংটন ভিত্তিক বিশ্লেষক।

সিএসআইএসের বিশ্লেষক ড্যানিয়েল বাইম্যান বলেন, 'হামাস ইরান থেকে সুড়ঙ্গপথে গাজায় অস্ত্র নিয়ে আসে। এর মধ্যে দূরপাল্লার অস্ত্রও থাকে।'

বিশ্লেষক চার্লস লিসটার বলেছেন, 'ইরান হামাসকে সমুদ্রপথে আরও আধুনিক ব্যালিসটিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়। এ ছাড়া গাজায় অস্ত্র উৎপাদনের জন্য উপকরণও পাঠায় তারা।'

গাজায় অস্ত্র উৎপাদন ও ইরানের প্রশিক্ষণ

বাইম্যান বলেন, 'ইরান একইসঙ্গে হামাসকে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনে সহায়তা করেছে।'

লেবাননভিত্তিক হামাস কর্মকর্তা আলি বারাকা রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমাদের সব ধরনের অস্ত্র উৎপাদনের জন্য কারখানা আছে। ২৫০, ১৬০, ৮০ ও ১০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করতে পারি আমরা। মর্টার ও মর্টারের গোলা, কালাশনিকভ (একে-৪৭) রাইফেল ও এর গোলাবারুদ, এসবই আমরা উৎপাদন করি। আমরা রুশদের অনুমতি নিয়ে বুলেট উৎপাদন করছি। আমরা গাজায় এসব উৎপাদন করি।'

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক চার্লস লিসটার জানান, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (আইআরজিসি) প্রায় দুই বছর ধরে হামাসের প্রকৌশলীদের অস্ত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

লিসটার বলেন, 'এই প্রশিক্ষণের ফলে হামাসের প্রকৌশলীরা তাদের অস্ত্র উৎপাদনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছেন।'

তেহরান নিয়মিত হামাসে অস্ত্র নির্মাতাদের প্রশিক্ষণ দেন বলেও জানান তিনি।

লিসটারের মতে, হামাসের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা ইরানের আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের অংশ, যার ফলে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ইরানে নিয়ে যাওয়া হয়।

কাঁচামালের উৎস ও রিসাইকেল

গাজায় কোনো প্রথাগত ভারী শিল্পকারখানা নেই। এ অঞ্চলের মূল শিল্পখাত হলো পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আসবাবপত্র। তবে এ অঞ্চলের প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো স্ক্র্যাপ লোহা।

এই স্ক্র্যাপ লোহা থেকেই সুড়ঙ্গ অবকাঠামোর নিচে অস্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব।

আল কাশেম ব্রিগেডের এক সদস্য। ফাইল ছবি: এএফপি

এ ছাড়া গাজায় আগের অসংখ্য হামলার সময় ধ্বংস বা অকেজো হয়ে যাওয়া অস্ত্র ও দালান থেকেও লোহার রড, ইস্পাত ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে হামাস।

ইসরায়েলের উড়োজাহাজ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে পাওয়া লোহা, ইস্তপাত, ধাতব পাইপ, বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য উপকরণ হামাসের অস্ত্র নির্মাণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এভাবে 'রিসাইকেল' করেও অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে হামাস।

মার্কিন বিমানবাহিনীর বিশ্লেষক অ্যারন পিলকিংটন জানান, শনিবারের হামলায় যে পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্র ব্যবহার করেছে হামাস,  হামাস সেটা দীর্ঘসময় ধরে জোগাড় করেছে।

লেবাননভিত্তিক হামাস কর্মকর্তা আল বারাকা বলেন, 'এই হামলার প্রস্তুতিতে দুই বছর সময় নিয়েছে হামাস।'

হামলা পরিকল্পনায় অন্য কোনো দেশ বা পক্ষের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু না বললেও বারাকা বলেন, 'হামাসের মিত্ররা তাদের 'অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে। ইরান সব সময় অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে আমাদের পাশে থেকেছে।'

পিলকিংটন বলেন, 'এক গাদা রকেট ছুঁড়ে হামলা চালানো কোনো জটিল ব্যাপার না। তবে বিস্ময়কর হলো, অনেকগুলো রকেটের মজুদ রাখা, এগুলোকে সরিয়ে নির্দিষ্ট অবস্থানে আনা এবং ইসরায়েল, মিসর ও সৌদি আরবের গোয়েন্দাবাহিনীর কঠোর নজরদারি এড়িয়ে একইসঙ্গে কয়েক হাজার রকেট ব্যবহার করে এরকম হামলা চালানো। হামাস বাহিনী ইরানের নির্দেশনা ছাড়া কীভাবে এটা সম্ভব করল, তা বোধগম্য নয়।'

Comments