বাংলাদেশের মিষ্টির সমাহার: ঐতিহ্য আর সুস্বাদের মিশেল

ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাইদ

যেকোনো শুভকাজে মিষ্টিমুখ করা যেন অপরিহার্য বাংলাদেশিদের জন্য। দেশে মিষ্টির খোঁজে বেরিয়ে পড়লে স্বাদে অনন্য বহু রত্নের খোঁজ মেলে। এগুলোর অনেকগুলোর কথা আমরা জানি। আবার কিছু মিষ্টি এতটা পরিচিতি না পেলেও স্বাদে হার মানাবে পরিচিত অনেক মিষ্টিকেই।

রাজধানী তথা দেশের কেন্দ্র ঢাকা থেকেই শুরু করা যাক। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের জন্য ঢাকা বহুল পরিচিত। ঢাকার খাবারেও মেলে এর ছোঁয়া। পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে এখনও মোঘল সাম্রাজ্যের ফেলে যাওয়া ভোজনবিলাসের ছাপ।

শাহি জিলাপি এর অন্যতম উদাহরণ। অন্যরা যখন মোটা আর চিকন জিলাপির বিতর্কে মশগুল, শাহি জিলাপি তখন নিজের বিশেষ মহিমায় উজ্জ্বল। তবে সব রাজকীয় মিষ্টিই কিন্তু ঢাকার নয়। শুধু ঢাকার মিষ্টিই ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধির জন্য নাম-যশ পায়নি। দেশের আরও নানা জায়গার আছে নানা বিখ্যাত মিষ্টি।

আমিত্তির উৎপত্তিস্থল বরিশাল বলে জানা যায়। আবার টাঙ্গাইলের চমচম দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়। পোড়াবাড়ির চমচমের নাম শুনলেই জিভে জল চলে আসে যেন। এর এত খ্যাতি-বিস্তৃতির পরও অনেকেই অবশ্য তর্ক জুড়ে দেন, অন্যান্য কিছু অঞ্চলের চমচমও সমান সুস্বাদু। যেমন কুড়িগ্রামের চমচমও টাঙ্গাইলের চমচমের মতো খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন অনেকে। এ চমচমটার মিষ্টি ভাব টাঙ্গাইলের চেয়ে একটু কম।

ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাইদ

মিষ্টি কিংবা বাংলাদেশের যেকোনো খাবারকেই সরাসরি যেকোনো একটা জেলার বলে দেওয়া কঠিন। খাবারদাবারের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর এগুলোর প্রাপ্তিস্থান এতটাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে শুধু বিশেষ একটি জায়গার সঙ্গে কোনো মিষ্টির নাম জুড়ে দেওয়া মুশকিল। সন্দেশের বেলাতেও তাই। বিভিন্ন জেলায় প্যাড়া সন্দেশ, গুড়ের সন্দেশ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ পাওয়া যায়।

তবে সবচেয়ে বেশি তর্ক-বিতর্কের শোরগোল উঠে রসগোল্লাকে নিয়ে। আর এক্ষেত্রে বিতর্কের দৌড় এপার বাংলাকে ছাড়িয়ে চলে যায় সীমান্তের অন্য পারেও। অনেকের দাবি, চাঁদপুরের রসগোল্লারই জয়জয়কার। যদিও অন্যদের মতে গোপালগঞ্জের রসগোল্লাই সবচেয়ে ভালো। নরম, রসালো, সাদা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শুকনো আর বাদামি রঙের এই 'অত্যন্ত নিরীহ, নিপাট ভদ্রলোক'  মিষ্টিটি কিন্তু বহু চায়ের কাপে ঝড় তোলা আলোচনার মূল চরিত্র!

গেল রসগোল্লা। বলুন তো, রসমালাইয়ের কথা বলা হলে প্রথমেই কোন জেলার কথা মনে পড়ে? নিঃসন্দেহে কুমিল্লা! প্রতিদিন মাতৃভাণ্ডারের সামনে থাকা দীর্ঘ লাইনই এর প্রমাণ। কিন্তু এ নিয়েও কিছু বিতর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, এখানকার রসমালাই নাকি একটু বেশিই মিষ্টি। তাদের মতে, সে তুলনায় জামালপুর আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসমালাই অপেক্ষাকৃত বেশি সুস্বাদু। অন্যদিকে আকারে বিশাল রসমালাইয়ের দেখা পেতে যেতে হবে ঝালকাঠিতে।

কোনো কোনো এলাকায় তো রসমালাইয়ের নামটাই পাল্টে গেছে। গাইবান্ধায় যেমন রসমালাইকে ডাকা হয় 'রসমঞ্জুরি'। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে শুধু মিষ্টির ব্র্যান্ড বা দোকানের কারণেই মিষ্টির খ্যাতি ছড়ায় না, অঞ্চলেরও এতে ভূমিকা থাকে। ঠিক যেমন মহাস্থানগড়ের কটকটি কিংবা শিবগঞ্জের চমচম।

অন্যদিকে বাতাসার মতো মিষ্টির স্থানটা একটু বিশেষ। এখানে একটি চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দিন দিন বাতাসা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এবং খুঁজলেও আগের মতো মেলে না! হয়তো আমরাই দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, বাতাসার মিষ্টি দিনগুলোও তাই হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতি জুড়ে থাকা রঙিন আর প্রাণবন্ত মেলার সঙ্গে বাতাসার পরিচয় বহু পুরনো। বড় হওয়ার দিনগুলোতে এসব মেলার সঙ্গে সম্পর্কও অনেকটা চুকেবুকে গেছে, আর বাতাসার সঙ্গেও অতটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না।

নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নদীগুলোও কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রা আর খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব রাখে। মাছে-ভাতে বাঙালিই শুধু নয়, শেষপাতে থাকা মিষ্টিতেও কি শক্তিমান নদীর স্রোতের কোনো ভূমিকা নেই? নিশ্চয়ই আছে।

বলা হয়, পদ্মার ইলিশ মাদারীপুরেই সবচেয়ে ভালো মেলে। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে এ জেলার মিষ্টিতেও। এ অঞ্চলের স্থানীয়রাই জন্ম দিয়েছেন ইলিশ মিষ্টির, যা কিনা পেটি মিষ্টি হিসেবেও পরিচিত। এই মিষ্টিটা মূলত নরম সন্দেশ, যা ইলিশ মাছের পেটির অংশের মতো ছাঁচে তৈরি করা হয়।

আকার-আকৃতির দিক থেকেই বাংলাদেশের বিচিত্র সব মিষ্টির চেহারা ভিন্ন রকম। মিষ্টির তালিকা থেকে পিঠাকে কী করে বাদ দেওয়া যায়? নরসিংদী বা চুয়াডাঙ্গার নিখুঁত সাজের নকশি পিঠা থেকে শুরু করে পার্বত্য অঞ্চলের ছেছমা পিঠা, নোয়াখালী আর বরগুনা অঞ্চলের বহু ধরনের মিষ্টি পিঠা আমাদের নিজস্ব খাদ্যভাণ্ডারের গৌরব।

আসলে বাংলাদেশের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এতটাই সমৃদ্ধ আর বৈচিত্র্যময় যে প্রতিটি জেলা ধরে এগোলেও সে তালিকা শেষ হওয়ার নয়। এই অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরের মিষ্টি-মানচিত্রটিও বহুমাসের পরিশ্রমের ফসল।

দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক বা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের সময় এই মিষ্টিগুলো চেখে দেখাও কিন্তু আমাদের 'বাকেট লিস্টে' থাকতে পারে।  

তো, বাহারি এসব মিষ্টি থেকে আপনি কতগুলো চেখে দেখেছেন?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক উদয়শংকর বিশ্বাস, রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী ও রান্না বিষয়ক প্রশিক্ষক শেফ শুভব্রত মৈত্রকে বাংলাদেশের মিষ্টিগুলোর নিয়ে এমন একটি নিবন্ধ তৈরি করতে সহায়তার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

23m ago