বুড়িতিস্তায় বাঁধ নির্মাণে স্বস্তিতে এলাকাবাসী

বুড়িতিস্তায় বাঁধ নির্মাণে স্বস্তিতে এলাকাবাসী
এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে বাঁধটিকে পরিষ্কার রাখছে। ছবি: স্টার

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বানপাড়ার চরে স্রোতস্বিনী বুড়িতিস্তা ও প্রমত্তা তিস্তার সংযোগস্থলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্মাণ করা বাঁধটি এখন ৩ ইউনিয়নের ৩০টি চরের লক্ষাধিক মানুষকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বন্যা ও ভাঙন থেকে বাঁচতে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। 

পাউবো ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বহু আকাঙিক্ষত বুড়িতিস্তার তীর বাঁধটি নির্মাণ করে। 

পাউবো এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বুড়িতিস্তা নদীটি বানপাড়ায় এসে তিস্তায় মিশেছে। মিলিত হওয়ার আগে নদীটির শেষ প্রান্তের গোলমুন্ডা পয়েন্ট থেকে বানপাড়া চর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশ ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় প্রতি বছর বন্যা ও নদী ভাঙন স্থানীয় মানুষদের জীবন ও জীবিকাকে দুর্বিসহ করে তুলতো। দুর্বিপাককে নিয়তি ভেবেই যুগের পর যুগ ধরে চলছিল তাদের জীবন।

পাউবোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মিত দুর্যোগের কবলে পড়ে জলঢাকা উপজেলার গোলমূন্ডা, শোলমারী ও কইমারী ইউনিয়নের ৩০টি চরের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের মানুষের জন্য এই ক্ষতি ছিল অভাবনীয়।

তবে দুর্গম চরের মানুষের কান্না কখনই সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের কানে এসে পৌঁছায়নি। যদিও প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আশ্বাসের ফুলঝুরিতে তাদের বুক ভিজিয়ে দিলেও ভোট পেয়ে বিজয়ী ও কম ভোট পেয়ে পরাজিত সবাই হয়ে যেত লাপাত্তা।

তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে সারা দেশের নদীগুলো পুনঃখননের নির্দেশনা দিলে পাউবোর নীলফামারী বিভাগীয় দপ্তর থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে পাঠালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে তা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়।

২০২১- ২০২২ সালে চাড়ালকাটা নদী সোজাকরণ ও বুড়িতিস্তার তীর সংরক্ষণ কাজের পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজের জন্য শত কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হলে শুরু হয় নদী রক্ষার ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।

পাউবোর নীলফামারী ডিভিশনের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান প্রধান এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুধু নদীতীর উঁচু করলেই সবসময় কার্যকরভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এজন্য নদীর তলদেশ খননও খুব জরুরি। উজান থেকে ধেয়ে আসা নদীর পানি যদি উঁচু তলদেশের কারণে নিষ্ক্রমণ হতে না পারে তাহলে পানি ফুলে ফেঁপে ক্রমাগত নদী তীরে আঘাত করে তা ভেঙে ফেলে, সৃষ্টি করতে পারে প্রলয়ংকরী বন্যা।'

'তাই বুড়িতিস্তার জন্য আমরা দীর্ঘ স্টাডির মাধ্যমে বাস্তবসম্মত প্রকল্প গ্রহণ করেছি। যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নদীর উভয় তীর টেকসইভাবে নির্মাণ, নদীর তলদেশ যথাযথ গভীরতায় খনন, সিসি ব্লক ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা কাজ সম্পন্ন করা এবং সবশেষে নদী তীরে বনায়ণ করা। যাতে করে বন্যা ও ভাঙন নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে বিপন্ন পরিবেশও প্রাণ ফিরে পায়। আমরা সেভাবেই কাজ করছি,' যোগ করেন হান্নান প্রধান।

দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক সম্প্রতি বাস্তবায়িত প্রকল্প এলাকার কয়েকটি চরাঞ্চল- বানপাড়া, বক্সিপাড়া ও তালুক শোলমারী ঘুরে দেখেন। দেখা গেছে, স্থানীয় সব বয়সের লোকজন বাঁধের ওপর আয়েশি ভঙ্গিতে বসে গল্প-গুজব করছেন। যদিও সেই বিকেলে দেশের সীমান্তের ওপার থেকে হঠাৎ আসা উজানের পানিতে নদী ছিল উত্তাল, কিন্তু তারা ছিলেন নির্বিকার। কেউ কেউ পালাক্রমে ঝাড়ু দিয়ে নিজেরাই সেটি পরিষ্কার করে রাখেন।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বুড়িতিস্তায় বন্যা সতর্কতার জন্য নির্ধারিত বিপৎসীমা যেখানে ৮ ফুট, সেখানে নির্মিত নদী তীরের উচ্চতা ১৪ ফুট।  আর এই নিরাপদ উচ্চতাই চরবাসীর ভয়হীন চিত্তের কারণ।

কয়েক বছর আগে ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হয়ে বর্তমানে অন্যের জমিতে ছনের ঘর তুলে কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছেন ওই এলাকার এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক মাহাতাবউদ্দিন। 

তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি দুঃখ করে জানান, আর যদি ২-৩ বছর আগে বুড়ি তিস্তায় বাঁধ তৈরি হতো, তাহলে তাকে এই বৃদ্ধ বয়সে নিঃস্ব হয়ে অন্যের জমিতে ভূমিহীন হয়ে বাস করতে হতো না।

তিনি বললেন, 'ভাঙনের শিকার হয়ে গত ১০ বছর আমাকে ৭ বার ভিটা ভেঙে অন্য জায়গায় ঘর বাঁধতে হয়েছে। আজ অন্যের জমিতে আমার ঘর থাকলেও নতুন বাঁধ হওয়ায় আমাকে আবারও ভিটা নড়াতে হবে না। তাই আমার দুঃসময়েও বেশ খুশি।'

এক সময়ের দুর্যোগকবলিত তালুক শোলমারী চরের ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সাত্তার ও পার্শ্ববর্তী বক্সিপাড়ার একই বয়সী তার স্কুলবন্ধু আলতাফ হোসেন ২ জনই খুব কাছ থেকে এই উন্নয়ন কাজ দেখেছেন।

তারা জানাল, তিস্তা ও বুড়ি তিস্তার অববাহিকার অন্য এলাকার মানুষ যখন বন্যায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্বিসহ জীবনযাপন করেন, তখন তারা নির্বিঘ্নে নিজ বাড়িতে থাকতে পারেন।

তিনি বলেন, 'পাউবোর ইঞ্জিনিয়ারদের একান্ত আন্তরিকতায় এত টেকসই কাজ হয়েছে। তাদের জন্য আমরা দোয়া করি।'

এ প্রসঙ্গে জলঢাকার ইউএনও মইনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে জানান, যে চরবাসীরা কিছু সরকারি ত্রাণের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আজ আর তাদের সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। বুড়ি তিস্তার বাঁধ তাদের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।

পাউবোর নীলফামারী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণকমল চন্দ্র সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন্যা ও নদীভাঙন রোধ ছাড়াও বুড়ি তিস্তার জন্য গৃহীত প্রকল্পটি পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নদী খননে নাব্যতা ফিরে আসায় সেখানে জীববৈচিত্র্য ফিরে এসেছে। ২ তীরে ব্যাপক বৃক্ষরোপন করায় নদী ভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধ হয়ে এলাকাটি সবুজাভ হয়ে উঠছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে এলাকাটিকে একটি টুরিস্ট স্পটে পরিণত করা।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

38m ago