অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সৈয়দপুরের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো

সৈয়দপুরে প্রস্তুত পোশাক পণ্য বিক্রির একটি দোকান। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে অবস্থিত রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো অস্তিত্ব রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে। এসব কারখানা মালিকদের অনেকে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা। অনেকে আবার বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে আসা রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সরকার করোনা পরবর্তী সময়ে মাত্র ৪ শতাংশ হারে সুদে ঋণ দিয়েছিল তাদের ব্যবসা পুনরুজ্জীবিত করতে। তবে এই সহায়তা পেয়েছেন মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন মালিক। বেশিরভাগই এ সুবিধার বাইরে থাকায় অনেকেই মহামারিকালে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো আর খুলতেই পারেননি। সহায়তাপ্রাপ্তরা সরকারের কাছ থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা পেয়েছেন।

ঋণ সুবিধার বাইরে থাকা মালিকেরা এখন বাধ্য হয়ে বেশি সুদে ঋণ, পরিচিতদের কাছ থেকে ধার বা স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে পুঁজি জোগাড়ের চেষ্টা করছেন।

এমনই একটি কারখানার মালিক ও রপ্তানিকারক খাজা গরীবে নেওয়াজ। নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি কারখানাটি আর খুলতে পারেননি।

খাজা গরীবে নেওয়াজ বলেন, 'বেশিরভাগ কারখানার মালিক মহামারিকালে পুঁজি ভেঙে সংসার চালাতে বাধ্য হয়েছে। সেই সময়ে অনেক দক্ষ শ্রমিক বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে গেছেন। ব্যাংকগুলোও আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ দিতে দ্বিধান্বিত। তারা ভাবে, আমরা হয়ত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারব না।'

এমনই আরেকটি কারখানার মালিক শাহেদুর রহমান কোনো ঋণ সুবিধা না পেয়ে মরিয়া হয়ে পুঁজি জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। অন্যথায় তিনি তার কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, 'আমার কারখানা ৩ বছর ধরে বন্ধ। পুনরায় চালু করতে মাত্র ১০ লাখ টাকা পুঁজি দরকার। কিন্তু কোথাও কোনো সহায়তা না পেয়ে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার চেয়েছি। পাব কি না, জানি না।'

করোনা পরবর্তী সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সৈয়দপুরের রপ্তানিমুখী এই পোশাক কারখানার মালিকরা যখন আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যা তাদের সামনে আবারও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রূপ-মিলন গার্মেন্টসের মালিক এরশাদ আলম পাপ্পু বলেন, 'মহামারির আগে আমি ভারতে প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ পিস পোশাক রপ্তানি করতাম। কিন্তু এখন কোনো রপ্তানি আদেশ আমার হাতে নেই। সবমিলিয়ে খুবই সমস্যায় আছি।'

সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির এই সহসভাপতি আরও বলেন, 'অস্তিত্ব রক্ষায় আমরা স্থানীয় বাজারের দিকে নজর দিয়ে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় কিছুটা সফলতা পেয়েছি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর ব্যবসায়ীরাও আমাদের পণ্যের আগ্রহ দেখিয়েছেন।'

সৈয়দপুরের ছোট ছোট পোশাক কারখানাগুলো পুঁজির অভাবে পুণরায় ঘুড়ে দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

এম আর গার্মেন্টসের মালিক ও রপ্তানিকারক মো. দলু বলেন, 'আমি প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ডলারের পোশাক ভারতে পাঠাতাম। এখন সেটা কমে ৩ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।'

সৈয়দপুরের এই পোশাক কারখানার মালিকেরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের উদ্ভাবনী মেধা কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানের সেলাই মেশিন দিয়ে কম দামে নানা বয়সীদের জ্যাকেট, জিনস প্যান্ট, ফুল প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, ট্রাউজার, শার্ট ও অন্যান্য সামগ্রী প্রস্তুত করে আসছেন।

এখানকার পোশাকের বিশেষত্ব হলো, এগুলো নতুন কাপড় দিয়ে তৈরি না করে কম দামে ঢাকার বড় বড় পোশাক কারখানা থেকে কেনা কাট পিস বা ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। ফলে, পোশাকের দামও অনেক কম হয়।

কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত কাপড়গুলো উন্নত কাপড়ের অব্যবহৃত অংশ হওয়ায় তা টেকসই ও মানের দিক থেকেও ভালো হয়। ফলে সৈয়দপুরে তৈরি পোশাক দ্রুতই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

এমনকি সৈয়দপুর শহরের বেশকিছু পরিবার নিজ বাড়িতে সেলাই মেশিন বসিয়ে নিজেরা কাজ করে কম খরচে পোশাক তৈরি করছেন।

রপ্তানিকারকরা তাদের কাছ থেকে এসব পোশাক প্রতিযোগিতামূলক দামে কিনে নেওয়ায় দ্রুতই এটা এই এলাকার সামাজিক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে।

সৈয়দপুর শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ভারত থেকে এসেছেন ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়। ফলে, তাদের ভারতীয় আত্মীয়-স্বজন প্রায়ই বাংলাদেশে আসেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে। বেড়াতে আসা এই মানুষদের মাধ্যমে এবং তাদের মধ্যে থাকা পোশাক ব্যবসায়ীদের আগ্রহে সৈয়দপুরে তৈরি কম দামের টেকসই এসব পোশাক ভারতে রপ্তানি শুরু হয়।

রপ্তানিকৃত পণ্যগুলো ভারতে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এখন ভুটান থেকেও রপ্তানি আদেশ দিচ্ছেন সৈয়দপুরের কারখানাগুলোতে।

সার্বিকভাবে কম দামের এই পোশাকগুলো বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি অপ্রচলিত পণ্য হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, তাদের সংগঠনে ৫৫ জন নিয়মিত সদস্য রয়েছেন।  এ ছাড়া, আরও ৫০০ জনের বেশি সহযোগী সদস্য রয়েছেন, যারা নিয়মিত সদস্যের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক দামে তৈরি পোশাক সরবরাহ করেন।

এসব কারখানায় ৬ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং তাদের পরিবারের অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ এর ওপর নির্ভরশীল বলে জানান আনোয়ার হোসেন।

সৈয়দপুরের পোশাক কারখানাগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে এক্সেসরিজসহ আরও নানা ব্যবসা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতীয় রপ্তানিকারক পুরানো আগারওয়াল, মেসার্স মংলা শাহ্, মেসার্স মদন কুমার, মেসার্স শ্যামল কুমারসহ অন্যান্যরা এ অঞ্চলের বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে এসব পোশাক পণ্য আমদানি করে।

কুয়েংগা টি ওয়াংগমোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভুটানে এসব পণ্য আমদানি করে।

পোশাক কারখানা মালিকদের সূত্রে জানা যায়, তারা ঢাকার বড় পোশাক কারখানাগুলো থেকে পরিত্যক্ত বা ঝুট কাপড় কেজি দরে কিনে নেন। তাদের প্রতি কেজি ব্লেজার তৈরির কাঁচামাল কিনতে হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। জ্যাকেট ও জিনস প্যান্ট তৈরির কাঁচামাল যথাক্রমে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা এবং ৮০ থেকে ১৫০ টাকায় কিনতে হয়।

তারা জানান, এসব কাপড় যদি মধ্যসত্বভোগীদের মাধ্যমে কিনতে না হতো, তাহলে দাম আরও কম হতো।

কারখানা মালিকরা পাইকারি দামে ছোটদের প্রতিটি জ্যাকেট ১৫০ টাকায় বিক্রি করেন, যা করোনা মহামারির আগে ছিল ১০০ টাকা। বড়দের জ্যাকেটের বর্তমান তাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, যা আগে বিক্রি হতো ৩০০ টাকায়।

সৈয়দপুর রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির সভাপতি আক্তার হোসেন খান বলেন, 'যদি বন্ধ কারখানাগুলো চালু করা যায়, তাহলে আমরা এ বছর ১০০ কোটি টাকারও বেশি পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ও বিদেশে বিক্রি করতে সক্ষম হবো।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago