যে ৫ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের হাতে বৈশ্বিক জিডিপির ১১ শতাংশ

প্রযুক্তি দানবদের দখলে বিশ্ব অর্থনীতি। ছবি: নাসডাক

শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল সবচেয়ে বেশি বাজারমূল্য নিয়ে ছাড়িয়ে গেছে বিশ্বের অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে। যার বর্তমান বাজার মূলধন ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। যেখানে, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্যের (ইউকে) জিডিপির আকার ২ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন ডলার। 
 
অ্যাপলের মতো এমন বিপুল পরিমাণ সম্পদশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করলেও অবাক হবার কিছু নেই। 

ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টিই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। আর ট্রিলিয়ন ডলারের ক্লাবে থাকা ৫টি কোম্পানির মধ্যে অ্যাপল, মাইক্রোসফট, আলফাবেট ও আমাজন এই ৪টি-ই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। 

সম্প্রতি, সেরা দশের তালিকা থেকে বাদ পড়ে ১১ নম্বরে চলে গেছে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা।

বিংশ শতাব্দির শুরুতে ডিজিটাল যুগের শুরু হয়। মাত্র ২ দশকের ব্যবধানে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিপণ্য। প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক অনলাইন দুনিয়া মানব জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তি দানবগুলো। যাদের একেকটার বাজারমূল্য বিশ্বের অনেক পরাশক্তি দেশের জিডিপির চেয়েও বেশি।

ছবি: ব্লুমবার্গ

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কেবল মানুষের জীবন-যাপনের ধরনের পরিবর্তন হয়নি, আমূলে পাল্টে গেছে সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো। করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রযুক্তি বিশ্ব ছিল এর ব্যতিক্রম। এই সময়ে কিছু প্রযুক্তি-দানব স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন করেছে। 

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট ফরহাদ মাঞ্জু বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ভয়ংকর ৫ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
 
শুধু ফরহাদ মাঞ্জু নন, অ্যাপল, আমাজন, গুগল, ফেসবুক ও মাইক্রোসফটের কাছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের যতগুলো বৃহৎ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন দেশের নির্বাচন, প্রচারণা, গোপন নথি ফাঁস, নজরদারি, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শুরু করে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও কোনো না কোনো প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান জড়িয়ে ছিল। 

এসব কারণে বিভিন্ন দেশ ও সরকার এখন নড়েচড়ে বসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে চালু হয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে দেশটির কংগ্রেসে সম্প্রতিকালে জেরার মুখে পড়েছে ফেসবুক, টুইটার ও গুগলের প্রধান নির্বাহীরা।

অ্যাপল সদর দপ্তর। ছবি: সংগৃহীত

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক আকার

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রযুক্তি দুনিয়ায় মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পরিচিত অ্যাপল। ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করার পর করোনা মহামারির ২ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলধন পৌঁছে যায় প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে।

সিএনবিসির একটি তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু এক বছরে অ্যাপল, আমাজন, মাইক্রোসফট, আলফাবেট, টেসলা ও ফেসবুক সম্মিলিত বাজার মূলধনে যুক্ত করেছিল ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এই সময়ে শীর্ষ ৫ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন ছিল ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। যা বর্তমান বিশ্বের সম্মিলিত জিডিপির ১১ শতাংশের বেশি! 

শুধু তাই নয়, স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০২১ সালে কেবল অ্যাপলের বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৬৬ বিলিয়ন ডলার। যা অনেক দেশের জিডিপির চেয়েও বেশি। 

অন্যদিকে, ২০২১ সালের শুরুতে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বাজার মূলধন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থায় থাকা মাইক্রোসফটের বছর শেষে মূলধন দাঁড়ায় ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। আর গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট বছর শুরু করেছিল ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন নিয়ে। যা বছর শেষে ২ ট্রিলিয়নের মাইলফলক স্পর্শ করে। 

করোনা মহামারির মধ্যে ঝড়ের বেগে বেড়ে ওঠা অ্যামাজন-এর বাজার মূল্য এই বছরে তেমন বাড়েনি। ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন নিয়ে শুরু করলেও বছর শেষে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারেই পৌঁছায়। অন্যদিকে চমক দেখিয়ে ট্রিলিয়ন ডলারের ক্লাবে নাম লেখায় টেসলা। ৬৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানটি।

তবে, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার চিত্রটা ছিল একটু আলাদা। এক সময়ের ট্রিলিয়ন ডলারের এই কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন নেমে গেছে ৫৬৫ বিলিয়ন ডলারে। ফলে, শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকা থেকেও স্থান হারায় মার্ক জাকারবার্গের এই জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। 

টেসলার হেডকোয়ার্টার। ছবি: টেসলারাতি.কম

প্রযুক্তি দানবগুলোর নিয়ন্ত্রণে জটিলতা

এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে যাবে তা হয়তো কেউ আগে কল্পনাও করেনি। মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই আবিষ্কারগুলো সমাজকে এভাবে বদলে দেবে তা হয়তো এর প্রতিষ্ঠাতারাও আগে কখনো ভাবেনি। যোগাযোগমাধ্যম কিংবা পণ্য কেনাবেচা, পরিবহণ কিংবা মহাকাশ অনুসন্ধান থেকে শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠান এখন বিশ্ব রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যসূত্রে, ৯/১১ থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ভুয়া খবরের প্রচারণা, কেলেঙ্কারি রটানো, মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা গুরুতর প্রভাব বিস্তার করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ প্লাটফর্মগুলো। এসব বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ। প্লাটফর্মের সৃষ্টি করা সমস্যা সমাধান অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও অসম্ভব। 

আমাজন সদর দপ্তর। ছবি: সংগৃহীত

ব্যবহারকারীরা তার ইচ্ছেমতো তথ্য প্রচার করতে এগুলো ব্যবহার করতে পারে। হ্যাকিং, ভিপিএন, বেনামে তথ্য প্রচার পুরোপুরি বন্ধ করার পদ্ধতি এখনো দেখা যায়নি। এর বাইরে ক্ষমতাসীন সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মিথ্যা সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি অর্জন করতে পারে। যা ভূমিকা রাখতে পারে নির্বাচনের ফলাফলেও। 

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের তথ্যসূত্রে, বিশ্বব্যাপী মেটার নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ৩০০ কোটির বেশি। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের সিংহভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাই করতে অক্ষম। তাই এখানে যেকোনো সরকার বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তাদের অসৎ ও স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্য হাসিলে যেকোনো তথ্য প্রচার করতেই পারে। সম্প্রতিকালে ইউক্রেন যুদ্ধে চালানো প্রচারণা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা নেতিবাচক দিক আছে, তা হচ্ছে বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।

আলফাবেটের হেড অফিস। ছবি: সংগৃহীত

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই আমেরিকাভিত্তিক

শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই আমেরিকাভিত্তিক, অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয় মার্কিন আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে। অথচ, বিশ্বব্যাপী এর গ্রাহক ছড়িয়ে আছে। স্বভাবতই আমেরিকা-বিদ্বেষী দেশগুলোতে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা থাকে। চীন, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ইরানসহ বেশ কিছু দেশে মার্কিন অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছে। 

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ ধরে বর্তমানে অনেক মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ, আমেরিকা-ভিত্তিক হওয়াতে এসব প্রতিষ্ঠানে মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির একটা প্রভাব খুবই স্পষ্ট। এছাড়া, আমেরিকাবিরোধী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেও অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজ দেশে নিষিদ্ধ করে।

মাইক্রোসফেটের হেড অফিস। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাই নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার বিশ্বব্যাপী, কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মার্কিন আইন অনুযায়ী। তবে, বর্তমানে অনেক দেশ ও সংস্থা এই প্রযুক্তি দানব কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মার্কিন প্রযুক্তি দানবদের ক্ষমতা রোধ করতে একক অবস্থান গ্রহণ করেছে। 

বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতির শীর্ষে বসতে হয়। রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠান এই রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তিতেই ক্ষমতার বলয় তৈরি করে। যুক্তরাজ্যের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন কিংবা জেনারেল মটরস, চীনের পেট্রোলিয়াম সংস্থা বা জার্মানির অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করেই রাষ্ট্রগুলো বরাবর বিশ্ব রাজনীতিতে দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। 

ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি দানবের কল্যাণে মার্কিন ক্ষমতা নতুন রূপ লাভ করেছে। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বেচ্ছায় নিজেদের সপে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ও ক্ষমতা অন্য সব সময়ের সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তীব্র ও বেপরোয়া। তাই, প্রতিটা রাষ্ট্রের জন্যে এদের প্রভাবে লাগাম টানতে দরকার স্বতন্ত্র আইন ও নীতিমালা।   

 

তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, ব্লুমবার্গ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, সিএনবিসি, স্ট্যাটিস্টা, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ ও রয়টার্স।

 

Comments

The Daily Star  | English

13 former BDR members walk out of jail after 16 years

Family members expressed overwhelming joy at the release, reuniting with their loved ones

29m ago