মহাকাশে অবকাশ যাপন
অবকাশ যাপনের জন্য অনেক সময় আমরা সমুদ্র, পাহাড় কিংবা বরফ অঞ্চলে গিয়ে ভালো কোনো হোটেলে উঠি। কোথাও ঘুরতে গেলে থাকার জন্য হোটেলের বিকল্প মেলা ভার। তবে সেই হোটেলটি যদি পৃথিবীতেই না হয়ে, মহাকাশে হয়?
এটুকু পড়ে হয়তো পাঠকের মনে হবে এটি কোনো সিনেমার গল্প বা সায়েন্স ফিকশনের কাহিনী! কিন্তু না, এই অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজেই নেমেছে 'অরবিটাল অ্যাসেম্বলি করপোরেশ' নামের একটি সংস্থা। তারা পরিকল্পনা করেছেন মহাকাশে এমন একটি হোটেল নির্মাণের, সেখানে ভ্রমণকারীদের থাকা, খাওয়া, ঘোরা- এমনকি নানারকম বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকবে।
সংস্থাটির প্রধান জন ব্লিনকাউয়ের পরিকল্পনায় আছে, অন্তত ২৮০ জন মানুষের থাকার মতো ব্যবস্থা তারা করবেন। সঙ্গে ১১২ জন কর্মচারী। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর মতো করে মানুষ মহাকাশেও ঘুরতে যাবে৷
পরিকল্পনার শুরু ২০১৯ সালে। ক্যালিফোর্নিয়ার এক কোম্পানি- গেটওয়ে ফাউন্ডেশন প্রথম ভেবেছিল একটা জাহাজ আকৃতির হোটেল তৈরি করবে, যেটা থাকবে মহাশূন্যে ভাসমান।
পৃথিবী ও মহাশূন্যের মধ্যবর্তী কারম্যান লাইন অতিক্রম করে এই জাহাজ আকৃতির হোটেল ভেসে থাকবে মহাশূন্যে। মূলত ২০২৫ সালে কাজ শুরু করে ২০২৭ সাল নাগাদ এটিকে পুরোপুরি চালু করার ইচ্ছা তাদের।
হোটেল স্টেশনটির প্রথম প্রস্তাবিত নাম ছিলো ভন ব্রাউন স্টেশন। ভন ব্রাউন ছিলেন একজন জার্মান অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নাজিপার্টি হয়ে পরবর্তীতে আমেরিকা গিয়ে নাসায় যোগ দেন। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে তিনি এরকম একটা স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেটিকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে ২৪টি মডিউলকে এলিভেটর প্যাসেজের মাধ্যমে সংযুক্ত করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে- এমন একটি ঘূর্ণায়মান চাকার মতো করে তৈরি করা হবে।
পরবর্তীতে হোটেলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ভয়েজার স্টেশন। ব্লিনকাউ আশা করছেন ২০২৬ সাল নাগাদ তারা এর নির্মাণকাজ শেষ করতে পারবেন। ২০২৭ সাল থেকেই মহাকাশে জমে উঠবে ভ্রমণকারী আর দর্শনার্থী দিয়ে।
'অরবিটাল অ্যাসেম্বলি করপোরেশন' এর প্রধান স্থপতি টিম এলাটোরের মতে, এই হোটেলে পৃথিবীর বুকে থাকা হোটেলগুলোর মতো সব সুবিধাই থাকবে। এখানে উন্নতমানের খাবার, অবসর যাপন, বিনোদন, এমনকি মুভি থিয়েটার রাখার ব্যবস্থাও থাকবে।
পাশাপাশি হোটেলের ইন্টেটেরিয়রের নকশায় থাকবে ভিন্নতা। এ ক্ষেত্রে মূল অণুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে স্ট্যানলি কুবরিকের '২০০১: আ স্পেস অডেসি' সিনেমাটি। তবে কুবরিক যা দেখিয়েছেন, তারা এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হোটেলটিকে সাজাচ্ছেন।
এলাটোর মনে করেন, কুবরিক মূলত প্রযুক্তি আর মানবিকতার ভেতরের ব্যবধান দেখিয়েছেন। যার কারণে যান্ত্রিক নকশাগুলো একেবারে স্পষ্ট ও আলাদা করেছেন। কিন্তু প্রযুক্তিকে সেরকম যান্ত্রিকতার ছাপে দেখতে চান না তিনি। তাই এখানে পৃথিবীর হোটেলগুলোর মতো সব ব্যবস্থাই থাকবে। যেমন- কনকনে ঠান্ডা আইসক্রিম। পাশাপাশি দর্শনার্থীরা এমন অনেক কাজ করতে পারবেন যেটা তারা পৃথিবীতে পারতেন না। আরও উঁচুতে লাফ দেওয়া এমনকি ভেসে বেড়ানো, কোনো ভারী জিনিসকে অবলীলায় তুলে ফেলা- এসব কিছুই হয়ে যাবে পানির মতো সহজ।
তবে এটি আসলেই কতটা বিজ্ঞানসম্মত হবে তা নিয়ে অনেকেরই মনে আছে প্রশ্ন। কিন্তু এলাটোর এ বিষয়ে পরিষ্কার। তার মতে, বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া অবশ্যই সম্ভব।
এখানে একটি ঘূর্ণায়মান চাকা থাকবে- যেটা ২৪টি মডিউল ব্যবহার করে তৈরি করা হবে। এই চাকার মাধ্যমে স্টেশনের ভেতরের জিনিসগুলোর ওপর একটা বাহ্যিক বল প্রয়োগ করা হবে। যেটা হবে পরিধি থেকে বাইরের দিকে ক্রিয়াশীল। ফলে এখানকার সব জিনিস স্থিতিশীল থাকতে পারবে। অনেকটা পানিভর্তি একটা বালতিকে সাবধানে ঘোরানোর মতো। পানিতে ঘূর্ণি তৈরি হবে, কিন্তু উপচে পড়বে না।
এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র-মধ্যবর্তী স্থানে কোনো কৃত্রিম অভিকর্ষ বল কাজ করবে না। তবে যত বাইরের দিকে যাওয়া হবে, তত মহাকর্ষের টান অনুভব করা যাবে। আমরা জানি, চাঁদে মহাকর্ষ শক্তির পরিমাণ পৃথিবীর ৬ ভাগের ১ ভাগ। প্রাথমিকভাবে এই হোটেলটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সেই বিশাল চাকা অন্তত এই পরিমাণ শক্তির যোগান দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে এটিকে মঙ্গলগ্রহের পর্যায়ে (মঙ্গলে মহাকর্ষ শক্তি পৃথিবীর ৩ ভাগের এক ভাগ) উন্নীত করা হবে বলে তারা ভেবেছেন।
সামনের দিনগুলোতে মহাকাশ পর্যটনের ব্যাপারটা আরও গুরুত্ব পেতে থাকবে বলেই মনে করেন তারা।
ইতোমধ্যে ভার্জিন গ্যালাক্টিক বা স্পেসএক্স-এর মতো কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিকভাবে মহাশূন্যে মানুষকে ঘুরিয়ে আনছে। ধনকুবের ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্স জনপ্রতি আড়াই লাখ ডলার বাজেটে দর্শনার্থীদের মহাকাশে ঘুরিয়ে এনেছে।
তবে ব্লিনকাউ এ ক্ষেত্রে আরও বড় লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। একটি হোটেল- যেখানে মহাশূন্যে ভ্রমণরত মানুষরা থাকতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ইলন মাস্ক তথা স্পেসএক্স-এর সহায়তাও চেয়েছেন তারা। পাশাপাশি সরকারি ও করপোরেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও এখানে সংযুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য আসলে মহাকাশকে পৃথিবীর মতো ভ্রমণের একটা স্বাভাবিক জায়গায় পরিণত করা। এলাটোর যেমন বলেছেন, 'আমাদের এখানে টিকেটের মূল্য হবে জাহাজ ভ্রমণের মতো। শুরুতে বেশি হতে পারে, তবে যখন অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে আসতে থাকবেন, তখন জাহাজ ভ্রমণের মতো কম খরচে এখানে থাকা যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমন একটা 'স্টারশিপ' সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই, যেখানে মানুষ মহাকাশে বেড়াতে আসবে, থাকবে, কাজ করবে। এটা হবে স্বাভাবিক আসা-যাওয়ার মতো। আর আমার মনে হয় সেটা করার ইচ্ছা মানুষের ভেতর যথেষ্টই আছে।'
Comments