পাঠাগার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে পাঠাগার। যার ফলশ্রুতিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে যুগে যুগে সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে। জ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষ ক্রমেই সভ্য ও আধুনিক হয়ে গড়ে উঠছে।

মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় পাঠাগারের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিনেভেহ-এর রাজা আশুরবানিপাল এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠান করেন। এ পাঠাগাওে হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি লিপি সংরক্ষিত ছিল। মাটি ও পাথরের ফলকে লেখা সুমেরীয় ও আক্কাদীয় লিপিগুলি এখানে সংরক্ষণ হতো ।

মিশরীয় সভ্যতায়ও পাঠাগারের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের এসব পাঠাগারে প্যাপিরাসে লেখা পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ হতো। তখনার সময়ে মিশরের রাজপ্রাসাদে স্থাপন করা হতো এসব পাঠাগার। প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় গ্রন্থ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার হতো পাঠাগার। বৌদ্ধবিহার ও মঠগুলোতে এসব গ্রন্থ ও পুঁথি সংরক্ষণ করা হতো। 

মধ্যযুগে সেন ও পাল যুগেও পুঁথি ও গ্রন্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও মহাস্থানগড়ে জ্ঞানচর্চার এ ধরনের গ্রন্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। এসময়ে ইউরোপের পাঠাগারেও এ ধরনের বই সংরক্ষণের ইতিহাস পাওয়া যায়। পরে নবাব ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন এলাকায় পাঠাগার গড়ে ওঠে। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন মসজিদের এসব পাঠাগার সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়।

এক সময় ধমীয় গ্রন্থ ও পুঁথি সংরক্ষণের জন্য পাঠাগার গড়ে উঠলেও ব্রিটিশ আমলে এ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ শুরু হয়। ১৮৪১ সালে ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন পাঠাগার 'আলিপুর লাইব্রেরি' প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর নাম পরিবর্তন করে 'কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি' করা হয়। ১৮৫৪ সালে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির আদলে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এসময় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের উদ্যোগ অনেক পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠাগার গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাঠাগার ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

২০২৩ সালে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, সারাদেশে ৭১টি সরকারি গ্রন্থাগার আছে রয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এক হাজার ৫৩২টি পাঠাগার সরকারিভাবে নিবন্ধিত। বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতির প্রকাশনা থেকে পাওয়া যায়, দেশে এক হাজার ৩৭৬টি বেসরকারি পাঠাগার। যদিও পাঠাগার আন্দোলনের দাবি, শুধুমাত্র ৪৭ জেলায় রয়েছে দুই হাজার ৫০০ পাঠাগার। তবে দেশে আসলে কতটি গ্রন্থাগার বা পাঠাগার রয়েছে সে হিসাব সরকারি বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই।

এক সময় পাঠাগারে প্রবেশ ছিল সংরক্ষিত। এখানে ধর্মীয় গুরু, রাজা-বাদশার পরিবার বা উচ্চ বংশীয় ধনীদের যাতায়াত ছিল। মুসলমার শাসকদের কল্যাণে পাঠাগার মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত হলে সেটি উন্মুক্ত হয়। আস্তে আস্তে পাঠাগার জ্ঞানের ভাণ্ডার ও শিক্ষার একটি অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়।

এখন পাঠাগার শুধুমাত্র বই পড়ার জায়গা নয়। এটি জাতির মেধা ও সংস্কৃতির বিকাশের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। জ্ঞানার্জন, গবেষণা ও সৃজনশীলতার উৎকর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এ পাঠাগার। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নেও পাঠাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে গুঞ্জন পাঠাগার, কথা বলছেন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা স্বপন মিয়া। ছবি ফেসবুক থেকে

পাঠাগারকে বলা চলে জ্ঞানের কেন্দ্র। এটি নতুন ধারণার জন্মভূমি। তবে এ পাঠাগারের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন রূপ নিয়েছে পাঠাগার। প্রাচীনকালে পাঠাগারকে জ্ঞান ও শক্তির আধার মনে করা হতো। তবে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার ও গণশিক্ষার প্রসারের ফলে পাঠাগার সম্পর্কে সমাজের ধারণা পাল্টে যায়। পাঠাগার তখন থেকে গণজ্ঞান ও শিক্ষার উন্মুক্ত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। আস্তে আস্তে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি চলে আসে। পাঠাগারে সব রকমের বই রাখা শুরু হয়। পাঠাগার দখল করে নেয় বিজ্ঞান, গবেষণা, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্যেও বই। এখন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের বিশেষ স্থান হিসেবে দেখা হয় এ পাঠাগার।

আধুুনিক তথ্যপযুক্তির প্রসারের ফলে পাঠাগারের ভূমিকা ও কার্যকারিতা অনেক বেড়েছে। গবেষণার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এ পাঠাগার। পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ, পত্রিকা, বই-স্মরণীকার জন্য ছুটে আসছে মানুষ। এমন প্রেক্ষাপটে পাঠাগারের আধুনিকায়ণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, অবকাঠামোর অভাব, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বাধা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সমস্যাতো রয়েছে। এতো এতো সমস্যার পরও পাঠাগার গড়ে উঠছে আবার পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়েও যাচ্ছে।

স্কুল জীবনে কয়েকজনের সঙ্গে লস্করহাট পাঠাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হলেও ব্যক্তিগতভাবে সে কাজটি করেছি নিজের মতো করে। কলেজ জীবনে ফেনীর রাজাঝির দিঘির পশ্চিমপাড়ের জেলা গ্রন্থাগারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। এসময় অনেককে এ পাঠাগারে আসতে দেখেছি। পত্রিকার টেবিলে একজনের পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছি কখন তিনি ছাড়বেন। সে সময় পাঠাগারে অনেক মানুষ আসতেন। কখনো কখনো বসার জন্য চেয়ারও পাওয়া যেতো না। রেকের পাশে দাঁড়িয়ে অনেক বই শেষ করেছি। সেসব স্মৃতি ভুলবার নয়।

কিন্তু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল গ্যাজেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ আগ্রহ কমছে বলে অনেকে ধারণা। তাছাড়া পাঠাগারের প্রতি মানুষের দৃষ্টি ফেরানো ও আকর্ষণীয় করে তুলতে সৃজনশী কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে পাঠাগারকে সম্পৃক্ত করতে পারলে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে।

পাঠাগারগুলোকে কেবল বইয়ের সংগ্রহস্থল না বানিয়ে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। নিয়মিত সেমিনার, বইমেলা, সাহিত্য আড্ডা, কর্মশালা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Lives on hold: Workers await reopening of closed jute mills

Five years on: Jute mill revival uneven, workers face deepening poverty

14h ago