‘কাপালিক’ থেকে ‘দাদা ভাই’: রহস্যময় সিরাজুল আলম খান

তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, যা করতে চেয়েছেন, তাই করেননি—করিয়েছেন।
সিরাজুল আলম খান
সিরাজুল আলম খান। ছবি: সংগৃহীত

বাস্তবে নয়, তিনি ছিলেন গল্পের বিষয়। দেশের অধিকাংশ মানুষই তাকে কোনোদিন দেখেননি, কিন্তু তার গল্প শুনেছেন। গল্পে তার প্রতি মোহ তৈরি হতো। তরুণরা সেই মোহে আকৃষ্ট হতেন। গল্পে কখনো তিনি কপালকুণ্ডলার 'কাপালিক', কখনো রাজনীতির 'দাদা ভাই'। জাসদ নেতা আ স ম রবের ভাষায় 'তিনি আমাদের নেতার নেতা, মহান নেতা, তাত্ত্বিক নেতা'। রহস্যময় জীবনযাপন তাকে রহস্য মানবে পরিণত করেছে। যতটা তাকে জানা যায়, অজানা থাকে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

বলছি সিরাজুল আলম খানের কথা।

বাংলামোটর এলাকায় ফুটপাত ধরে তাকে হেঁটে যেতে দেখেছি। কাশফুলের মতো সাদা-লম্বা চুল, বড় বড় গোঁফ-ভ্রু, লম্বা দাড়ি। পরনে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি বা ফতুয়া। ঠিক যেন বইয়ে পড়া ঋষি বা দরবেশের অবয়ব। বেশ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন শাহবাগের দিকে। সম্ভবত হাতে একটি লাঠিও থাকত। পরে জেনেছি, তার গন্তব্য শেরাটন হোটেল। এটা ছিল তার জীবনের প্রায় প্রতিদিনের রুটিন।

তাকে দেখা বলতে এতটুকুই। কোনোদিন সামনা-সামনি দেখা হয়নি, কথা হয়নি। কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। জেনেছিলাম, তিনি তার রাজনৈতিক শিষ্য বা অনুগত বা পরিচিত বিশ্বস্তজন ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা বা কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না।

সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে স্নেহধন্য প্রভাবশালী ছাত্রনেতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম রূপকার। তার রহস্যময় জীবন-কর্মকে রহস্যের চাদরে আবৃত রেখেই আজ তিনি চলে গেলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে। বেশকিছু দিন অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। নীরবে এক ধরনের অবহেলায় কাটল তার শেষ সময়টা। গণমাধ্যমও তার খবর নেয়নি, তার খবর তেমন একটা প্রকাশ করেনি।

অথচ তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, যা করতে চেয়েছেন, তাই করেননি—করিয়েছেন। ঠিক এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন সিরাজুল আলম খান।

বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে ও পরে—তার রাজনৈতিক জীবনের দুটি অধ্যায়।

দেশ স্বাধীনের আগের সিরাজুল আলম খান ছিলেন বিচক্ষণ, দূরদর্শী চিন্তার এক সৃজনশীল ছাত্রনেতা। বঙ্গবন্ধু তার অদ্বিতীয় নেতা। শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে পরিচালনা করছেন বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে। ১৯৬২ সালের দিকে ছাত্রলীগের ভেতরে গড়ে তুলেছেন 'নিউক্লিয়াস'। নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। নিউক্লিয়াসের প্রধান কাজ আন্দোলন, সংগ্রামকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নিয়ে যখন তর্ক-বিতর্ক চলছে, সিরাজুল আলম খান তখন দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছেন ৬ দফার পক্ষে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছাত্রলীগ পালন করেছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ তৈরি করেছেন যে, ৭ মার্চের ভাষণে যেন 'স্বাধীনতার ঘোষণা' দেওয়া হয়।

সেই সময়েই গোপনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) গঠন করেছেন বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে জেনারেল উবানের অধীনে।

সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ধারণা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির চেয়েও বঙ্গবন্ধু বেশি পছন্দ ও নির্ভর করতেন সিরাজুল আলম খানের ওপর। শেখ মনির সঙ্গে তার শীতল ও বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি অজানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকালীনও দ্বন্দ্ব চলমান থাকে, বৃদ্ধি পায়। স্বাধীনতার পর যা বড়ভাবে দৃশ্যমান হয়ে সামনে আসে। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের মতাদর্শ-পৃষ্ঠপোষকতা ছাত্রলীগের ২ গ্রুপ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে চলতে থাকে। ১৯৭২ সালে একই দিনে ছাত্রলীগের ২ গ্রুপ ২ জায়গায় সম্মেলনের ঘোষণা দেয়। ২ গ্রুপই সম্মেলন উদ্বোধন করাতে চায় বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে। বহু জল্পনা-কল্পনা, নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মনি সমর্থিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপস্থিত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের দৃশ্যমান সূচনা মূলত তখন থেকেই। যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, কখনো কমেনি।

সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় মূলত এখান থেকেই শুরু। হয়তো এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের বীজ তিনি ধারণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-ভারতে অবস্থানকালীনই। তার জীবনযাপন, ঘুমানো বা না ঘুমানো, খাওয়া ও না খেয়ে থাকা শিক্ষাজীবন থেকেই রহস্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে তার রহস্যময় রাজনীতি ও জীবন বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে রহস্য তিনি কখনো উন্মোচন হোক তা চাননি। প্রশ্ন বিষয়েও নীরব থেকে গেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্কের অবনতি যত দ্রুত গতিতে তীব্র আকার ধারণ করেছে, তা বিস্ময়কর।

যেমন: ১৯৭২ সালের অক্টোবরে শেখ ফজলুল হক মনি ও মোস্তফা মহসিন মন্টুকে দায়িত্ব দিয়ে যুবলীগ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যুবলীগের কমিটি গঠনের ৪-৫ দিনের মধ্যে ৩১ অক্টোবর সিরাজুল আলম খান গঠন করলেন 'জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)'। মেজর (অব.) জলিল ও আসম রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটি ঘোষণা করেন। সিরাজুল আলম খান জাসদের কোনো পদে থাকলেন না। তার নাম কোথাও থাকল না। অথচ তিনিই জাসদের সর্বেসর্বা।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এত দ্রুত গতিতে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব হলো?

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধুকে যিনি অবিসংবাদিত নেতা মানেন, সেই তিনিই ৮-৯ মাসের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ গঠন করলেন কেন? গঠন করতে হলো কেন?

প্রথমত, এসব প্রশ্নের জবাব সিরাজুল আলম খান কখনো দেননি। নিজে কোনো সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেননি। নিজে কিছু লেখেননি। ডিকটেশন দিয়ে কিছু ছোট ছোট পুস্তিকা লিখিয়েছেন। সেগুলো থেকে কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে ২টি বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ ও শামসুদ্দিন পেয়ারা। দুজনেই জাসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠজন। মহিউদ্দিন আহমদের বই 'প্রতিনায়ক' ও শামসুদ্দিন পেয়ারার বই 'আমি সিরাজুল আলম খান'।

মহিউদ্দিন আহমদের বইটিতে লেখক অনেক প্রশ্ন ও রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তিনি বারবার কথা বলেছেন, প্রশ্ন করেছেন। একই প্রশ্ন একাধিকবার করেছেন। সেসব প্রশ্নের কখনো দুয়েক বাক্যে অসম্পূর্ণ উত্তর দিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীরব থেকেছেন। বইটি থেকে অনেক কিছু জানা গেলেও গুরুত্বপূর্ণ বহু রহস্য রহস্যই থেকে গেছে।

শামসুদ্দিন পেয়ারার বইটি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন বা রহস্যের উন্মোচন করতে চাওয়া হয়েছে কি না, সেটা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়। সিরাজুল আলম খান এই বইটিতে জাসদ গঠন বিষয়ে বলেছেন 'আর কোনো উপায় ছিল না'। গণবাহিনীর কর্মকাণ্ড, ভারতীয় হাইকমিশনে হামলার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সিরাজুল আলম খান বলেছেন, তাকে না জানিয়ে করা হয়েছে।

তিনি দল গঠন করছেন, নেতা তৈরি করছেন, নীতি নির্ধারণ করছেন। কর্নেল তাহের  সেনাবাহিনীর ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তৈরি করছেন। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার যোগাযোগ হচ্ছে। কোনো পদে না থেকে জাসদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে চাইছেন। বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করতে চাইছেন। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি 'গণকণ্ঠ' পত্রিকা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু সরকারের তীব্র সমালোচনা,জাসদ ও নিজের মতাদর্শ প্রচার শুরু করেছেন। 

জাসদ গঠন, গণকণ্ঠ প্রকাশ, গণবাহিনীর অস্ত্রের যোগান, এসবের জন্যে অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই অর্থ কোথা থেকে জোগাড় হয়েছিল, কে বা কারা অর্থ দিয়েছিল? অর্থ দেশের ভেতর থেকে না বাইরে থেকে এসেছিল?

স্বাধীনতার আগে তিনি যখন ছাত্রলীগ করেছেন, তখনকার অর্থকষ্ট, বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব কীভাবে অর্থ দিয়েছেন, তা বলেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সিরাজুল আলম খান এমন কিছু করেছেন বলে জানা যায় না, যা দিয়ে তিনি দল গঠনের মতো অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেন, পত্রিকা পরিচালনা করতে পারেন। এমনকি শেরাটন হোটেলে তার প্রায় প্রতিদিনের আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ার অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার এই অধ্যায়ের রাজনীতির পুরোটা  রহস্যময়তার চেয়েও বেশি কিছু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, তখন সিরাজুল আলম খান ভারতে অবস্থান করছিলেন। আগস্টের ১ বা ২ তারিখে তিনি ভারতে যান। শামসুদ্দিন পেয়ারার 'আমি সিরাজুল আলম খান' বইয়ে তিনি বলেছেন, '…বেলা ১১টার দিকে রেডিওতে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা শুনলাম। তখন আমি কোলকাতায়। ঘটনাটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। তার পরিণতি রাজনৈতিকভাবে না হয়ে, এভাবে যে মর্মান্তিকভাবে হলো, আর সেটাও পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ—এ সত্যটি মেনে নিতে আমার খুবই কষ্ট হয়েছে।'

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এমন নির্বিকার প্রতিক্রিয়াই তিনি ব্যক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাসদ উল্লাস করেছে। 'খুনি মুজিব খুন হয়েছে' তাৎক্ষণিকভাবে লিফলেট প্রকাশ করেছে (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদের বই 'জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি')। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে জাসদ নেতারা মিটিং করেছে, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছে।

সিরাজুল আলম খান এই সময়ে দেশে অবস্থান না করলেও তার পরিকল্পনা-নির্দেশনা ও বুদ্ধি-পরামর্শ ছাড়া জাসদ পরিচালিত হয়েছে, তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

সিরাজুল আলম খানের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অজানা অধ্যায়গুলো অজানাই রয়ে গেল। একমাত্র তিনি বলে বা লিখে গেলেই সেটা বিশ্বাসযোগ্য হতো। এরপর হয়তো অনেক গল্প থাকবে, মিথ থাকবে, অনেক রকমের ঘটনা আসবে, তার কাছের মানুষ নানা গল্প বলবেন। কিন্তু সেগুলো কেবল গল্পই থাকবে, ইতিহাসে জায়গা পাবে বলে মনে হয় না।

স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পেছনে যে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগে বিভক্তি ও জাসদ গঠন পরবর্তী  রাজনীতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থেকে যাবেন সিরাজুল আলম খান। তিনি খুব বড় পরিসরে বা গুরুত্বপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে স্থান করে থাকবেন, তেমনটি মনে হয় না। 'রহস্য পুরুষ', 'কাপালিক', 'দাদা ভাই' রহস্য হিসেবেই থেকে যাবেন। তার অধিকাংশ বিষয়েই মানুষের জানা থাকবে না। বহু প্রশ্ন থেকে গেল, উত্তর থাকল না।

Comments