কাছে-দূরের সিরাজুল আলম খান

দাদা সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে এমন একটা ধারণা ছিল যে, এই মানুষটা রহস্যময়। যেকোনো সময়ে কিছু একটা ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনিও একজন মানুষ। একজন ভিন্ন ধরণের মানুষ। যার মধ্যে একটি সম্ভাবনা ছিল।
অক্সফোর্ডে প্রিয় লেখক নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে সিরাজুল আলম খান। ছবিতে আরও আছেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা ও হাবিব বাবুল। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনীতির এক রহস্যময় মানুষ। আমি যখন স্কুলবালক, তখন থেকেই তার নাম জানি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় আমাদের স্কুল থেকে মিছিল বের করা হতো। জগন্নাথ কলেজ থেকে ছাত্রনেতারা আসতেন। এসে বলতেন—আজ ক্লাস হবে না, স্ট্রাইক। আমরা স্কুল থেকে বের হয়েই মিছিলে গিয়ে স্লোগান তুলতাম— জেলের তালা ভাঙতে হবে, শেখ মুজিবকে আনতে হবে।

সেইসময়ে রাজ্জাক, তোফায়েল, সিরাজুল আলম খানের নাম জগন্নাথের ছাত্রনেতাদের কাছে শুনেছি। ওনার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে। উনিসহ ৪ জন যুবক বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জের কালিন্দি ইউনিয়নের নেকরোজবাগ আসেন মোস্তফা মহসীন মন্টুদের বাড়িতে। আমি নদীর ঘাট থেকে তার পেছনে পেছনে মন্টুদের বাড়ি পর্যন্ত যাই। তাদের একজনের হাতে একটা টেপরেকর্ডার ছিল, পরে জেনেছি সেটা তার অন্যতম সহকারী সুমন মাহমুদের টেপ রেকর্ডার।

সুমন মাহমুদ নিজেই একজন মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ। পরে তারা আরও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে গেলেন কলাতিয়ার গগনদের বাড়িতে। বোরহান উদ্দিন গগন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন; ৭৩ এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বাড়িটিকে মুক্তিযুদ্ধের আঁতুড়ঘর বলা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান এ বাড়িতে বসেই আন্দোলনের পরিকল্পনা করতেন।

৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর পেছনে বসা সিরাজুল আলম খান। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় হয়। তিনিই প্রথম স্লোগান দেন—বিশ্বে এলো নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ। আমরাও তার স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়ে এই স্লোগান ধরি। তখনও ছাত্রলীগ ভাগ হয়নি। কিছুদিন পর টের পেলাম ছাত্রলীগ ভাঙছে। ডাকসুতে ছাত্রলীগের দুটো প্যানেল হলো। কয়েকটি হল ছাড়া ছাত্রলীগ হেরে গেল। ছাত্রলীগের ভাগটা আরও স্পষ্ট হতে থাকল। জুনে সম্ভবত সম্মেলন হল। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিতে সিরাজ ভাই পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাককে।

মুশতাককে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'তুইও থাকলি না?' এই বলে বঙ্গবন্ধু মুশতাককে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। এটা মুশতাক ভাই আমাকে বলেছেন। কিন্তু আজও অজানা, কেন সিরাজ ভাই না গিয়ে মুশতাককে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এরমধ্যে ছাত্রলীগ ভাগ হলো। সিরাজুল আলম খান আমাদের আদর্শ তখন। তিনি আড়ালে থেকেই সবকিছু করছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিস ৪২ বলাকা ভবন থেকে। আমরা তখন কিশোর। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরা একদল যুবক সন্ধ্যায় সেই অফিসে বসেন। আমরা যাই। তাদের কাছ থেকে রাজনীতি শিখি। আমাদের বলা হলো—বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি? এই প্রশ্নের জবাবে একজন আমাকে বলেছিল, নরমাল ওয়াটার ও ডিস্টিল ওয়াটারের যে পার্থক্য, সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যেও এমন পার্থক্য।

সিরাজ ভাই সবাইকে নীহাররঞ্জনের 'ছোটদের রাজনীতি ও অর্থনীতি' পড়তে বলতেন; ডা. নীহাররঞ্জন একজন মার্ক্সবাদী লেখক। তারপর অক্টোবরে জাসদ গঠন করা হলো। সিরাজ ভাইকে আমরা দাদা বলতাম। তিনি কী বলেন, তার জন্য সবাই অপেক্ষা করত। অনেকে আবার বানিয়ে বলতেন—দাদা এইটা বলে, এটা করতে হবে। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি দাদার কথাতেই সিদ্ধান্ত নিত। দুয়েকজন ছাড়া তাকে প্রশ্ন করার মতো কেউ ছিল না।

১৯৭৩ সালের নির্বাচন এলো। জাসদ ঘোষণা দিল, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটের গণকণ্ঠ অফিস থেকে নির্বাচনের কাজ করা হচ্ছে। আমি মাঝে মাঝেই যেতাম নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে। একদিন একটি রুমে বসে দাদাকে চিৎকার করে বলতে শুনলাম, 'তুমিই ডামি, তুমিই ডামি'। পরে জানলাম যে তিনি টেলিফোনে প্রার্থী খুঁজছেন। যাকে প্রার্থী খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাকে বলছেন, 'ডামি হলেও একজন প্রার্থী খুঁজে বের কর। না পাওয়া গেলে তুমিই প্রার্থী।'

দাদা এভাবে পরিশ্রম করে সেই সময়ে প্রার্থী খুঁজে খুঁজে ৩০০ আসনে জাসদের প্রার্থী দিয়েছিলেন। তিনি একদিন গণকণ্ঠ অফিসের প্রেস থেকে নিজে বহন করে এনে আমাকে নির্বাচনের পোস্টার দিয়েছিলেন। আমার ডায়রিতে এটা আমি লিখে রেখেছিলাম। অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন তখন। সারাদিন ঘুমিয়ে বিকেল কিংবা সন্ধ্যার দিকে উঠতেন। তাকে একবার মধ্যম সারির একজন নেতা বলেছিলেন, 'আপনি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকেন। দেশে তখন কতকিছু ঘটে যায়।' উনি তখন এর জবাবে বলেছিলেন, 'দেশে যা কিছু ঘটে রাতেই ঘটে। তোমরা তখন ঘুমাও, আমি তখন জেগে থাকি।' তিনি জাসদ অফিসে খুব কম আসতেন, গণকণ্ঠেই বেশি আসতেন। তার আরও অনেক শেল্টার ছিল। তার ঘনিষ্ঠরাও তা জানতেন না।

'৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সেখান থেকে অনেককে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, ধরা পড়লে যাতে ইত্তেফাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তিনি ধরা পড়েছেন। ইত্তেফাকের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে তার কথা হয়েছিল, ধরা পড়ার সংবাদটা যেন অন্তত ছাপিয়ে দেয়।

আমি ১৯৭৭ সালে দেশ ছাড়ি। দাদার অন্যতম সহকারী রায়হান ফেরদাউস মধু ভাইয়ের সম্মতিক্রমেই। জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নেই। দাদা তখন কারাবন্দি। তিনি আমাকে বলেছেন, নির্জন সেলে তাকে রাখা হয়েছিল, জেলে একাকী থাকতেন। সেই সময় একটি ইঁদুর তাকে সঙ্গ দিত। তিনি তার খাবারের একটি অংশ ইঁদুরকে দিতেন। তিনি অপেক্ষা করতেন, ইঁদুরটি কখন আসবে।

২০০১ সালে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে ঢাকায় সিরাজুল আলম খান। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই কাহিনীগুলো দাদা পরে আমাকে বলেছেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৮৪ সালের দিকে লন্ডন আসেন। ওঠেন আমার খুব ঘনিষ্ঠ স্বাধীনতার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি আ ত ম গিয়াসুদ্দিন খিজিরের বাসায়। এর কিছুদিন পর অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনও লন্ডনে আসেন। তারা দুজনেই খিজির ভাইয়ের বাসায় উঠেন।

আমি তখন জাসদ থেকে বহিষ্কার হয়েছি রব ভাইয়ের সঙ্গে একটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে। লন্ডন থেকে আমাকে ফোনে জানালেন দাদার লন্ডন আসার সংবাদ এবং জার্মানিতে আসবেন জানালেন। তখন আমি মান্না-আখতারের সঙ্গে বাসদে যোগ দিয়েছি। আমি অত আগ্রহ দেখালাম না। খিজির ভাই দাদাকে আমার ঠিকানা দিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

দাদা জার্মানিতে এসে উঠেছেন আমাদের এক সিনিয়র ভাইয়ের বাসায়; তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন ১৯৭২ সালে। ওনার নাম গোলাম কিবরিয়া। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তখন ভালো না। তিনি আমার বাসার সামনে দাদাকে দিয়ে গিয়েছেন। দাদা হাতে একটা কাগজ নিয়ে আমার বাসার নাম্বার খুঁজছেন। গরমের দিন। আমি বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দাদাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসি।

আমি তখন বাসায় একা ছিলাম। বিয়ে করিনি; ব্যাচেলর। বাসায় কোনো খাবার ছিল না। বেশিরভাগ সময় বাইরে খাই। শুধু চিপসের প্যাকেট আর চা ছিল। তাকে চিপস খেতে দিলাম। উনি বললেন, 'কিছুক্ষণ পরে প্যাকেট সরিয়ে নেবে। কারণ আমি এগুলো খাওয়া শুরু করলে স্টপ করতে পারি না।' সেইদিন দাদার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হলো। রাতে তিনি চলে গেলেন কিবরিয়া ভাইয়ের বাসায়। আমাকে বলে গেলেন, 'কিসের বহিষ্কার? কে কাকে বহিষ্কার করে? তুমি আগের মতোই আছ।'

দেরাদুনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান কথা বলছেন। সময়টা ১৯৭১ সালের। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তারপর '৮৮ সালে একবার এসে আমার বাসাতেই উঠলেন। ওনাকে নিয়ে ঘুরলাম জার্মানির বিভিন্ন এলাকায়। রাজনৈতিক, সিরিয়াস কথাবার্তা কম হতো। একটা নতুন কিছু দরকার, এ কথা তিনি বারবার বলতেন। স্বাধীনতার আগের বিভিন্ন কাহিনী জানতে চাইলে তিনি বলতেন, 'দেশ তো স্বাধীন হয়েছে। এখন দেশের কীভাবে উন্নতি হবে সেটা আলোচনা কর। অতীত নিয়ে তোমাদের এত আগ্রহ কেন?' তখন তিনি শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ নিয়ে কাজ করছেন।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি আবার লন্ডনে এসে আমাকে ফোন করলেন। তিনি ব্রাসেলসে আসবেন। আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, 'আমার ৬ সপ্তাহ ছুটি আছে। স্ত্রী ছেলেসহ দেশে গেছে। আমি আজই বিকেলে ট্রেন ধরে ব্রাসেলস আসছি।'

বিকেলের ট্রেন ধরে ব্রাসেলস গেলাম। সেখানে দাদার এক ভক্ত সোবহান চৌধুরীর আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। দাদা ব্রাসেলসে আসলেন। খিজির ভাইও এসেছিলেন লন্ডন থেকে। তিনি দুদিন থেকে লন্ডন ফিরলেন। আমি দাদার সঙ্গে রয়ে গেলাম। এরমধ্যে দাদার সঙ্গে আমস্টারডাম এবং হেগ গেলাম। আমস্টারডামে বিমানের ম্যানেজারের বাসায় উঠলাম। দাদার কর্মী ছিলেন সেই ভদ্রলোক। খুব খাতির-যত্ন করলেন।

পিটার কাস্তার এ সময় হল্যান্ড থেকে ঢাকায় গিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। তিনি কীভাবে কীভাবে খবর পেয়ে আমাদের খুঁজে বের করে চায়ের নিমন্ত্রণ দিলেন। দাদা সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। আমরা একটি রেস্তোরাঁয় বসলাম। কিন্তু আলোচনা জমলো না। পিটার অনেকটা হতাশ হলেন। পিটারকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার বাসাতেও এসেছে। 'শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ' বইটি আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। জাতিতে ডাচ হলেও অসাধারণ বাংলা জানেন পিটার। যদি বলি আমার চেয়েও ভালো বাংলা জানেন, তবু বেশি বলা হবে না।

নেদারল্যান্ড থেকে আবার ব্রাসেলস হয়ে আমিও দাদার সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে লন্ডন গেলাম। দাদার ও আমার ঘনিষ্ঠ খিজির ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। দাদা সারাদিন ঘুমান, বিকেলে উঠেন। খিজির ভাই অফিস থেকে ফেরেন আর বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা ভাইও সেখানে নিয়মিত আসেন। আড্ডা জমে ওঠে। দাদা নিজেই চা বানিয়ে আমাদের পরিবেশন করেন। আমিও মাঝে মাঝে চা বানাই। দাদাকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। আমি চাকে কখনো না বলি না।'

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে জেনারেল ওবানের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দাদা বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে রসিকতা করেন। বলেন, 'মুজিব ভাই তোমাকে বলতেন, "বাদশা তোমার দ্বারা ভালো কাজ বা খারাপ কাজ- কোনোটাই হল না।'" বাদশা ভাই খুব অমায়িক একজন মানুষ, অত্যন্ত বিনয়ী। কথার ফাঁকে ফাঁকে পুরনো কথা তোলেন। একদিন দাদাকে বলে ফেললেন, 'আপনারা এর প্রতিবাদে একটি বিবৃতিও দিলেন না?' এই কথা শুনে দাদা নীরব হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'মুজিব ভাইয়ের মতো একজন মানুষ হাজার বছরেও সৃষ্টি হবে কি না, জানি না।'

ওই আড্ডায় বঙ্গবন্ধুর কথা বললেই তিনি নীরব হয়ে যেতেন। একদিন রাতে আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আপনার সঙ্গেই শেষ কথা বলেছিলেন (বঙ্গবন্ধু)। কী কথা হয়েছিল? সেই রাতে কী বলেছিলেন তিনি?' এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দাদা আমাকে বলেছিলেন, 'ওয়াজেদকে জিজ্ঞেস করো। সে বলুক কী কথা হয়েছিল।'

পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার প্রস্তাব নিয়ে তিনি প্রথম গিয়েছিলেন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর কাছে। কিন্তু চৌধুরী এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। এ কথাও দাদা বললেন আমাকে। সেই সময় তিনি আমাকে আনিয়ে বিকেলে বের হতেন লন্ডন শহরের বিভিন্ন এলাকায়। লন্ডনের ন্যাশনাল লাইব্রেরি তার প্রিয় জায়গা ছিল। আমাকে নিয়ে যেতেন সেখানে, বই পড়তেন।

আমাকে একদিন তিনি বললেন, 'আগে মনে করতাম, আমরা অনেক কিছু জানি। কিন্তু এখানে এসে মনে হয় আমরা কিছুই জানি না।' মজার ব্যাপার হলো, লন্ডনে সেই সময় তিনি একটি লাঠি ব্যবহার করতেন। কিন্তু তার লাঠির দরকার ছিল না। তিনি আমার চেয়ে দ্রুত বেগে হাঁটতেন। আমার হাতে লাঠিটি দিয়ে দিতেন। আমি না করতে পারতাম না। মানুষ লাঠির কারণে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।

পূর্ব লন্ডনে বনফুল নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানেও আড্ডা দিতেন দাদা। আমিনুল হক বাদশা, গাফফার চৌধুরীসহ আরও অনেকেই আসতেন সেখানে। লন্ডনের আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান শরিফের সঙ্গেও তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সুলতান শরিফ মাঝে মাঝে খিজির ভাইয়ের বাসায় ফোন করে জানতে চাইতেন, 'সিরাজ কি উঠেছে?'। তারা প্রায় সমসাময়িক বন্ধুর মতো।

পরিবারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হল্যান্ডের হেগে দাদার এক বন্ধু ছিলেন। নাম ডা. ইউসুফ। আমাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলেন তার সুন্দর ছবির মতো বাড়িতে। গিয়ে দেখি, ইউসুফ ভাই বাড়িতে একা। তার ছেলে মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে। তার স্ত্রী পাকিস্তানি। তিনি পাকিস্তানে থাকেন। তার মেয়ে লন্ডনে থাকে। রাতে আড্ডার সময় ইউসুফ ভাই বললেন, 'সিরাজ, বিয়ে করা ভালো। না করা আরও ভালো।' সিরাজ ভাই তখন তার কাহিনী শুনলেন। পরদিন আমাদের ইউসুফ ভাই ভ্যানগগের মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে গেলেন।

সিরাজ ভাই প্রত্যেকটা ছবি থেকে অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলেন ধৈর্যের সঙ্গে। তার মধ্যে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, কোনো কিছুকেই তিনি অবহেলা করতেন না। সবকিছুকেই সিরিয়াসলি দেখতেন। ১৯৯৪ সালে লন্ডনে অবস্থানকালে আমিনুল হক বাদশা ভাই খিজির ভাইয়ের বাসায় এসে খবর দিলেন, নীরদ সি চৌধুরী সাক্ষাত দিতে রাজি হয়েছেন। আমরা কালই অক্সফোর্ড যাচ্ছি দুপুরের পরে। দাদাকে খুব উৎফুল্ল দেখাল। নীরদ সি চৌধুরী দাদার খুব প্রিয় লেখক। আমিও অনেক আনন্দিত।

কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু প্রতি বছর অক্টোবরে লন্ডন যেতেন নীরদ সি চৌধুরীর লেখা আনতে। তার কাছে নীরদ সি চৌধুরীর অনেক গল্প শুনেছি। নীরদ সি চৌধুরীর বইও আমাকে উপহার দিয়েছেন বাদল বসু। পরদিন দুপুরের একটু পর আমি, দাদা, বাদশা ভাই, খিজির ভাই রওনা হলাম অক্সফোর্ডে। নীরদ সি চৌধুরী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

আমরা পৌঁছাতেই তিনি দরজার কাছে এসে উষ্ণতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। আমাদের ২ ঘণ্টা সময় দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আড্ডা শুরু হলো। প্রায় ৬ ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। দাদা উপমহাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে তার সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলোচনায় মগ্ন হলেন। আমি নীরদ সি চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তিনি বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলেন? তিনি আমাকে বললেন, 'তোমাদের দেশ পূর্ব বাংলা হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ নয়।' তিনি আমাদের বাংলাদেশের সীমানা বোঝালেন। আমরা এটা নিয়ে তার সঙ্গে আর তর্কে জড়ালাম না।

দাদার সঙ্গে নীরদ সি চৌধুরীর বৈঠকের সময় বাদশা ভাই বাংলাদেশ সৃষ্টিতে দাদার ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেন। দাদা এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। দাদা শুধু বাংলাদেশ সম্পর্কে নীরদ সি চৌধুরীর ভূমিকা জানতে আগ্রহী ছিলেন। আমার কাছে এই সাক্ষাৎকারটি স্মরণীয় হয়ে রইল। বাদশা ভাই এই আলোচনা নিয়ে লেখার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু কিছুই লিখলেন না। আমিও অনেকবার বলেছি বাদশা ভাইকে লেখার জন্য। কিন্তু আজ লিখব, কাল লিখব করে করে আর লেখেননি। এখন তিনি পরপারে। তিনিও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন।

লন্ডন থেকে আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে আসব। আমার দেড় মাসের ছুটি শেষ। আগের দিন দাদার মন খারাপ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আসতেই হবে। খুব ভোরবেলা আমার ট্রেন ছিল। দাদার কাছ থেকে আগের রাতেই বিদায় নিয়েছি। সকালে তার সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি তো তখন ঘুমিয়ে থাকবেন। ভোরবেলা উঠে আমি রেডি হচ্ছি। এমন সময় তার কণ্ঠ শুনলাম, 'এই খিজির আমিও যাব।' খিজির ভাই বললেন, 'আপনার যাওয়ার দরকার নেই।' আমিও বললাম, 'আপনি ঘুমান।' দাদা বললেন, 'কি বলছ? আমিও যাব। তুমি যাবে আর আমি কি করে ঘুমাই। আমি তোমাকে দিয়ে আসি।' সেদিন একটু আগেই ষ্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ষ্টেশনে কফি শপে একসঙ্গে কফি খেলাম। আমি বিদায় নিয়ে আসলাম।

দাদা সম্পর্কে অনেকে অনেক সময় অমূলক ধারণা করেন। একবার ঢাকায় তার সঙ্গে রিকশা করে পুরানা পল্টনে মেসবাহ ভাইয়ের অফিসে যাচ্ছি। নির্মল সেন সেটা দেখে ফেলেছেন। তারপর আমাকে ডেকে নির্মলদা বললেন, 'তুমি যে ওনাকে (সিরাজুল আলম খান) নিয়ে এই এলাকায় ঘোরাফেরা করতেছ, যদি কিছু হয় তা হলে আমরাও ফেঁসে যাব।' আমি বললাম, 'কি হবে?' নির্মলদা বললেন, 'উনি কখন কি ঘটান তা কি বলা যায়?' পরে আমি এই কথা দাদাকে বলেছিলাম। উনি শুনে হেসে উঠলেন। আমাকে বললেন, 'কি ঘটাবো?'। আমি বললাম, 'হয়তো নির্মলদা মনে করছেন আবার ক্যু করার চেষ্টা করছেন।'

দাদা সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে এমন একটা ধারণা ছিল যে, এই মানুষটা রহস্যময়। যেকোনো সময়ে কিছু একটা ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনিও একজন মানুষ। একজন ভিন্ন ধরণের মানুষ। যার মধ্যে একটি সম্ভাবনা ছিল। বঙ্গবন্ধু যদি তাকে ধরে রাখতে পারতেন, তা হলে স্বাধীনতার পর জাতি বিভক্ত হতো না। দেশেও সেই সময় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাহস কেউ পেত না। দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যেত।

লেখক: জার্মানপ্রবাসী, সাবেক ছাত্রলীগ (জাসদ) নেতা

Comments